১৮৮৯ সালে প্রখ্যাত সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী অশ্বিনীকুমার দত্ত তার পিতার নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন, তার পিতা কলকাতায় জজ ছিলেন। প্রথমে অবশ্য এটির যাত্র শুরু হয় ব্রজমোহন স্কুল হিসেবে, ১৮৮৪ সালে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুরোধে। পরে এটি কলেজে রুপান্তরিত করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালে কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। সেসময়ে এ কলেজের মান এতই উন্নত ছিল যে একে দক্ষিণ বাংলার অক্সফোর্ড বলে আখ্যায়িত করা হতো। ১৯৬৫ সালে কলেজটির জাতীয়করণ করা হয়। ১২৬ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত কলেজ ২/৪ ঘন্টায় পরিদর্শন করা সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি প্রতিষ্ঠাকালীন মূল দুটি ভবন, দেখেছি অনেকগুলো পুকুর, শুনেছি কলেজ ক্যাম্পাসে ৮ বড় পুকুর রয়েছে। কলেজ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে লেখার কলেবর বৃদ্ধি করার ইচ্ছে নেই; যে একউ ইচ্ছে করলেই এটি সম্পর্কে যে কোন সময়ে তথ্য পেতে পারবেন।
এরপরে নগরীর কেন্দ্রস্থলে দুপুরের আহার শেষ করে আরো সংক্ষিপ্ত সময়ে দেখা হয় অশ্বিনী কুমার টাউন হল এবং বিবির পুকুর দর্শন।
১৯০৬ সালে রাজা বাহাদুরের হাবেলিতে মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য অশ্বিনীকুমার দত্ত একটি হল নির্মাণের প্রস্তাব করেন। ১৯২০ সালে অশ্বিনীকুমারকে সভাপতি ও শরৎচন্দ্র গুহকে সম্পাদক করে হল নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই বছরেরই ১৫ অক্টোবর রাজা বাহাদুরের হাবেলির মালিকদের নিকট থেকে জমি ক্রয় করা হয়। পরের বছর আগস্ট মাসে হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৩০ সালে। মাঝখানে অশ্বিনীকুমার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা নেয়া হয় এবং সেখানেই ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত এক শোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে নির্মাণাধীন হলের নামকরণ করা হয় অশ্বিনীকুমার টাউন হল। জমি ক্রয় থেকে শুরু করে হল নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল মোট চল্লিশ হাজার টাকা। এ অর্থের যোগান এসেছিল অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন এবং ১৯২১ সালের প্রাদেশিক সম্মেলনের জন্য সংগৃহীত তহবিল থেকে। যাঁদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টায় হলের নির্মাণকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছিল তাঁদের মধ্যে শরৎচন্দ্র গুহ, অ্যাডভোকেট বরদাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গামোহন সেন, ইঞ্জিনিয়ার জ্যোতিষচন্দ্র লাহিড়ী, ওয়হেদ রাজা চৌধুরী, হাশেম আলী খান, বাদশা মিয় চৌধুরী, ইসলাম খান চৌধুরী প্রমুখের নাম স্মরণীয়।
তাঁর আদর্শ ছিল সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা। বরিশালবাসীরা তাঁর এ আদর্শের উপর ভিত্তি করে হলটির কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও নানা বিনোদনের চাহিদা মেটাতে হলটি দক্ষিণবঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি আজও বরিশাল তথা দক্ষিণবঙ্গের শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার মূল কেন্দ্র। বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্র সদর রোডে এটি অবস্থিত। শুরু থেকেই এখানে বিভিন্ন ধরনের সভা, সেমিনার, নাটক, মেলা ও মৌসুমী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে।
অশ্বিনী কুমার টাউন হলের অনতি দূরেই বিবির পুকুর। সংক্ষিপ্ত সময় সেখানে অবস্থান এবং সন্ধ্যাকালে সেখানকার সৌন্দর্য্য উপভোগ না করেই দ্রুত অন্যত্র গমন। জেনে নেই বিবির পুকুরের ইতিকথা।
ব্রিটিশ আমলে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা (মিশনারি) বরিশালে আসে। জানা যায়, উইলিয়ম কেরি পর্তুগিজ দস্যুদের কাছ থেকে জিন্নাত বিবি নামের এক মুসলিম মেয়েকে উদ্ধার করে তাকে লালন-পালন করেন। পরবর্তীতে এক মুসলিম যুবকের কাছে জিন্নাত বিবিকে বিয়ে দেয়া হয়। উইলিয়ম কেরি জিন্নাত বিবিকে জেনেট বলে ডাকতেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে জিন্নাত বিবি জনগণের জলকষ্ট নিরসনের জন্য জলাশয় খননের উদ্যোগ নেন ও এ অনুযায়ী নগরীর সদর রোডের পূর্ব পাশে ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮৫০ ফুট প্রস্থ একটি পুকুর খনন করা হয়। তখন থেকেই পুকুরটি বিবির পুকুর নামে পরিচিতি লাভ করে। একসময় কীর্তনখোলা নদীর সাথে এ পুকুরের দুটি সংযোগ ছিল এবং এতে নিয়মিত জোয়ার ভাটা হত। সংযোগ দুটির একটি বরিশাল সার্কিট হাউজ হয়ে মৃতপ্রায় ভাটার খালের মাধ্যমে কীর্তনখোলায় এবং অপরটি নগরীর গির্জা মহল্লার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিলুপ্ত খালের মাধ্যমে কীর্তনখোলা নদীর সাথে যুক্ত ছিল। বরিশাল পৌরসভা স্থাপনের পর থেকেই বিবির পুকুরটি বিভিন্নভাবে সংস্কার ও পুনর্খনন করা হয়। ৯০ এর দশকে পৌর চেয়রম্যান আহসান হাবিব কামাল পুকুরটির ঐতিহ্য রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করলেও তা যথাযথ ভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৮ সালে শওকত হোসেন হিরণ বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের এর মেয়র নির্বাচিত হওয়র পর বিবির পুকুরের ঐতিহ্য রক্ষা এবং সৌন্দর্য্য বর্ধনে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এর মধ্যে পুকুরের চারপাশে ঝুলন্ত পার্ক, বিশ্রাম নেয়র জন্য বেঞ্চ, অত্যাধুনিক গ্রিল ও পুকুরটির শোভা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের লাইটিং স্থাপন উল্লেখযোগ্য। এর পাশাপাশি বিবির পুকুরের পাশেই উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র পাবলিক স্কয়আর (বর্তমানে হিরণ স্কয়ার নামে পরিচিত) এবং পুকুরের মধ্যে ফোয়রা স্থাপন করেন। বিবির পুকুর বর্তমানে একটি নাগরিক বিনোদনের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিকেলে ও সন্ধ্যায় জনগণ আড্ডা ও অবসর সময় কাটানোর জন্য পুকুর পাড়ে ও হিরণ স্কয়রে জড়ো হয়। ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জনগণের জন্য পুকুরের চারপাশ ও হিরণ স্কয়র এলাকায় ফ্রি ওয়ই-ফাই সুবিধা যুক্ত করা হয়।
হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে; রাতে ঢাকার ফিরতে হবে, সদরঘাট থেকে। তাই চট-জলদি শেষ এবারের শেষ গন্তব্য ত্রিশ গোডাউন এলাকায় কীর্তনখোলা দর্শন।
নগরীর কীর্তখোলা নদীর পাড় ঘেষা ত্রিশ গোডাউন নদীর পাড়ে একটি নব নির্মিত বিনোদন কেন্দ্র। বিনোদন প্রেমিদের কাছে টানছে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর তীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দিনের আলোতে প্রাকৃতিক দৃশ্যের নৈসর্গিকতার পাশাপাশি কুলু কুলু ধ্বনিতে বয়ে চলা কীর্তনখোলা নদীর পানির গতির সাথে মাঝির বৈঠার ছলাত ছলাত শব্দ যেকোনো বিনোদনপ্রিয় মানুষকে মুগ্ধ করে তুলছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে খানিক রাত অবধি নদীর কূলে মানুষের আনাগোনা কীর্তনখোলা নদীর দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। সারাদিন হৈ চৈ, আনন্দে মাতামাতি, দর্শনার্থীদের বাড়তি বিনোদন হিসেবে নৌকা-ট্রলার ও সি-বোট রয়েছে প্রমোদ ভ্রমণের জন্য। নদীর মাঝামাঝি কিংবা এপার-ওপার সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের জন্য নৌকায় উঠে থাকেন দর্শনার্থীরা। একটু দূরবর্তী দপদপিয়া সেতু, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বেলতলা ফেরিঘাটের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য আগ্রহী দর্শনার্থীরা ট্রলারে (ইঞ্জিন চালিত নৌকা) ভ্রমণ করে থাকেন। দিনের আলো শেষে সন্ধ্যার পরে নদী আর চাঁদের জ্যোস্নার সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন শত শত উৎসুক মানুষ। কেউ কেউ চাঁদের মায়াবী আলোতে গভীর রাত পর্যন্ত উপভোগ করেন নয়নাভিরাম এ সৌন্দর্য।
চাঁদের আলোয় কীর্তনখোলার সৌন্দর্য্য উপভোগ করার মতো সময় হাতে নেই; তাই আমরা পড়ন্ত বিকেলে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চেপে বসলাম সে সময়ের শান্ত কীর্তনখোলার বুকে। গরমের দাপট কমে আসছে, চমৎকার দখিনা বাতাস বইছে। সকলেই ছবি তোলায় ব্যস্ত। খানিক বাদে চোখে পড়লো নৌকায় জেলেদের ইলিশ শিকারের দৃশ্য। চালককে বলে গতি কমিয়ে কাছি যাওয়া, অবশ্যই জেলেদের অনুমতি নিয়ে। তখন অবশ্য জাল টানা শেষ পর্যায়… কাছে গিয়ে আমাদের ক্যামেরায় ধরা পড়লো দুটো জ্যান্ত ইলিশ, লাফাচ্ছে। খুব কম মানুষই জ্যান্ত ইলিশ দেখেছে। আজ আমাদের গ্রুপের সকলেই উচ্ছ্বসিত এমন জ্যান্ত ইলিশ দেখে। জেলেদের অনুরোধ করায় নৌকার খোলে রাখা আরো জ্যান্ত মাছ দেখালো। প্রস্তাব এলো মাছ কেনার… আলোচনা চললো। হুমায়ূন আর আমাদের চালকের মধ্যস্থ্যতায় নয়টি ইলিশ কেনা হলো, সবগুলোই মাঝারি আকারের। দামের কথা বললে চমকে যাবেন অনেকে, ন’টি ইলিশ ৯০০ টাকা, আহা!
কথা ছিলো আরো খানিকক্ষণ থাকবো নদীতে। পরিকল্পনা পরিবর্তন করে রূপাতলীতে ফেরার প্রস্তুতি, নৌকার গতিপথ পরিবর্তন করা হলো; অবশ্য এর মধ্যে বরিশাণ বিশ্ববিদ্যালয় দেখার ছোট্ট একটা সুযোগ নেয়া হলো নৌকার ইঞ্চিনের জন্য তেল নেয়ার সময়টাতে।
সন্ধ্যার আগেই রূপাতলী পৌঁছে গ্রুপের সদস্যগন নিজেরাই মাছ কোটা এবং ভাজার দায়িত্ব নিলেন; ইত্যবস্যরে আমি একটু গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়।
ইলিশ ভেজে যাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে তবে আমায় ডাকা হলো। ৩০ মিনিটেরও কম সময়ে আমরা যাত্র করলাম সদরঘাটের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য ঢাকা, দেশের সবচেয়ে বড় লঞ্চ কীর্তনখোলা-১০ হবে আমাদের বাহন।
লঞ্চেই শেষ হলো ৯ ইলিশের ভাজি করা টুকরোগুলো… আর বলতে চাই না; পাঠকের মনটাও তো বিবেচনা করতে হবে!
পরদিন সকালে ঢাকা সদরঘাট, শেষ হলো আমাদের বরিশাল-ঝালকাঠী-স্বরূপকাঠী ভ্রমণ। সকলেই সুন্দর একটা ফুরফুরে মন নিয়ে ছুটলো স্ব স্ব বাস্স্থানের দিকে। অনেকেরই তো যোগ দিতে নিজ কর্মস্থলে, বিদায় পর্বটা হলো অতি সংক্ষিপ্ত। তবু স্মৃতি রয়ে গেল সকলের মনে এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণকালের, যা হয়তো একসময়ে কোন না কোন ভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে।
(শেষ)
• ইতিহাসের তথ্যসমুহের কিছু অংশ উইকিপিডিয়া এবং বাংলাপিডিয়া থেকে নেয়া হয়েছে। বেশীরভাগ ছবি গ্রুপের সদস্যদের তোলা, দু’একটা নেট থেকে নেয়া হয়েছে।