প্রবন্ধ

কার্টুন ও একজন কার্টুনিস্ট

নুরুল্লাহ মাসুম

শেখ তোফাজ্জল হোসেন, তোফা ভাইকে নিয়ে ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৮ তারিখে প্রকাশিত আমার একটি নিবন্ধ নতুন করে এখানে প্রকাশ করলাম।

সংবাদপত্র জগতে কার্টুন একটা বিরাট স্থান দখল করে আছে। আর যিনি কার্টুন আঁকেন তাকে হতে হয় সমাজ সচেতন, প্রজ্ঞার অধিকারী। বিশ্বের সর্বত্রই ক্রমে কার্টুনের চাহিদা বাড়ছে। আমাদের দেশেও মানুষ এখন বেশ কার্টুন-প্রিয় হয়ে উঠেছেন। বর্তমান জনপ্রিয়তার কারণে কার্টুন সম্পর্কে বলার অনেক কিছুই থাকতে পারে।
যিনি বাংলাদেশের একমাত্র কার্টুনিস্ট নন বটে, তবে কার্টুন এঁকে নিরাপত্তা আইনে বন্দী হয়েছিলেন কেবল তিনিই। নাম শেখ তোফাজ্জল হোসেন। কার্টুনিস্ট হিসেবে তিনি ‘তোফা’ নামে পরিচিত। কখনো কখনো ‘ছারপোকা’ নামেও তিনি কার্টুন এঁকেছেন। এঁকেছেন ‘হুতুম’ এবং ‘ডেভিলসান’ নামেও।
প্রথম কবে কার্টুন আঁকেন এবং কোন পত্রিকায় তা প্রকাশ পায়, জানতে চাইলে তোফা ভাই বলেন:
– ১৯৬৬ সালে। সাপ্তাহিক সৈনিকে তা প্রকাশিত হয়।
– সেদিনের সেই প্রথম কার্টুনটির বিষয়বস্তু আপনার মনে আছে কি?
– যদ্দুর মনে পড়ে সি এস পি কর্মকর্তাদের আন্দোলন চলাকালে বর্তমান সচিব জনাব এ জেড এম শামসুল আলমের অনুপ্রেরণায় ওঁদের আন্দোলনের স্বপক্ষে কার্টুনটি আঁকি।
সেই শুরু। তারপর থেকে তোফাজ্জল হোসেন একাধারে কার্টুন এঁকে চলেছেন। যদিও কার্টুন আঁকাটা পেশা হিসেবে নেয়াটা সম্ভব নয়, তবুও নিজস্ব পেশার পাশাপাশি অনলস ভাবে তিনি কার্টুন এঁকে চলেছেন।
১৯৬৮ সালের প্রথম দিকের কথা। বছর খানেক পূর্বে চাকরী জীবন শুরু করেছে তিনি। দেশব্যাপী গণ বিক্ষোভ চলছে। পাকিস্তানের শাসকগণ পূর্বাঞ্চলকে যে কি নির্মমভাবে শোষণ করেছে, তা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে চিরকাল। তরুণ কার্টুনিস্ট তোফার কলমের খোঁচায় তা স্পষ্ট করে ফুটে উঠল ‘আর্তনাদ’ নামের একটি সংকলনে। আর্তনাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত একটি সংকলন। কার্টুনটির বিষয়বস্তু ছিল এমন:
পাক-ভারতের একটি ম্যাপ। দুই প্রান্তে পাকিস্তানের দু’টি অঞ্চল। একটি গাভী, তার মুখ পূর্ব পাকিস্তানে, পশ্চাৎভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে। গাভীটি পূর্ব পাকিস্তানে ঘাস খাচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা তার দুধ দুইয়ে নিচ্ছে।
ক্যাপসন বিহীন ঐ কার্টুনটিই শুধু নয়, আরো গুটি কয়েক এ ধরনের কার্টুন তখন প্রকাশিত হয়, ঐ একই সংকলনে। পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর চোখ এড়ায়নি-‘আর্তনাদ’- এ অঙ্কিত এসব কার্টুন; চোখ এড়াবার কথাও নয়। সেই সাথে সরকারের দৃষ্টি থেকে ‘তোফা’ও রেহাই পাননি। পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হলো তাঁকে। সময়টা ছিল ১৯৬৮ সালের মার্চ মাস। সুদীর্ঘ ১১ মাস তিনি কারাগারে কাটালেন নিরাপত্তা আইনে বন্দী হয়ে। এ প্রসঙ্গে তোফাজ্জল হোসেন বলেন:
‘স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের যে অবদান রয়েছে তা অনস্বীকার্য। কেউ হয়তো সরাসরি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, কেউবা কলম সৈনিক হিসেবে। আমিও আমার ভাষার স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছি। কার্টুন এঁকে জেল খেটেছি, এমনটি আরো কোনদিন হয়নি। এটাই আমার তৃপ্তি। স্বাধীনতার জন্য আমার য করার ছিল তা করেছি’।
স্বাধীনতার পর গতানুগতিক ভাবে তিনি ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে হাত মেলাননি বলে কোন স্বীকৃতি পাননি শেখ তোফাজ্জল হোসেন। অবশ্য আন্তরিকভাবে তিনি কখনো তা চানও নি। তবুও দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গীকৃত এই কার্টুনিস্ট কোন সরকারের আমলেই তাঁর কৃতকর্মের স্বীকৃতি পেলেন না কেন, এটাই আমার জিজ্ঞাস্য।
স্বাধীনতার পরেও ক্রমাগত কার্টুন আঁকতে থাকেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার কার্টুন এঁকেছেন বলে জানালেন এবং এগুলো যে সকল পত্রিকায় বেরিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দৈনিক মর্নিং নিউজ, বাংলাদেশ টাইমস, ডেইলি নিউ নেশন, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, দৈনিক দেশ, সাপ্তাহিক সৈনিক, সাপ্তাহিক দেশবাংলা, সাপ্তাহিক নিউ নেশন, হলিডে। অধুনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মাসিক কার্টুন নামক পত্রিকাতেও তিনি কার্টুন এঁকেছেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক মিল্লাতের কার্টুনিষ্ট (সর্বশেষ খবরে প্রকাশ যে, দৈনিক মিল্লাতের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে)।
শেখ তোফাজ্জল হোসেনের ‘তোফা’ ও ‘ছারপোকা’ নামে আঁকা কার্টুনের কপি দেখতে চাইলে কার্টুন ফাইল বের করে দিলেন। সংগ্রহে অনেক কার্টুন নেই। বিশেষত স্বাধীনতার পূর্ব কার্টুনের কোন সংগ্রহ নেই, কেননা সেগুলো তখনকার পুলিশে নিয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার শালমারা গ্রামের মরহুম শেখ সমশের আলী সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র তোফাজ্জল হোসেনের শৈশব কেটেছে আসামে, লেখাপড়া শুরু হয় গ্রামের বাড়ীতেই। পাঁচভাই ও এক বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় তোফাজ্জল হোসেনের পরিচয় শুধু কার্টুনিস্ট হিসেবেই নয়, তিনি একাধারে কবিতা লিখেছেন, দু’টি বিশিষ্ট জাতীয় দৈনিক উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন, রেডিও বাংলাদেশে সংবাদ পাঠ করেছেন। এক সময়ে রেডিওতে উত্তরণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতেন, টেলিভিশনে কয়েকটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। পেশাগত দিক থেকে তিনি বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত এবং দীর্ঘদিন তিনি মাসিক সবুজ পাতায় সম্পাদক ছিলেন। বিএ, বিএড ডিগ্রীধারী বিলকিস আখতার তোফাজ্জল হোসেনের সহধর্মীনী এবং তাদের দু’টি কন্যা সন্তান রয়েছে। কর্মজীবনে বিলকিস আখতারের সহযোগিতা ও ত্যাগ তোফাজ্জল সাহেবের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছে।
নতুন প্রজন্মের কার্টুনিস্টদের সম্পর্কে তার কোন উপদেশ বা মন্তব্য করছেন কি না জানতে চাইলে স্বভাব সুলভ গম্ভীর্য রেকে মৃদু হেসে বললেন:
একজন কার্টুনিস্টকে রাজনৈতিক মতবাদের উর্দ্ধে থেকে সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে জনগণের কল্যাণে গঠণমূলক কার্টুন আঁকতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে সরকারের সমর্থনে বা বিপক্ষে কার্টুন আঁকা যেতে পারে। মোদ্দা কথা সত্যকে তুলে ধরাই তার দায়িত্ব।
সত্যবাদী কার্টুনিস্ট তোফাজ্জল হোসেনের দেয়া নতুনদের প্রতি উপদেশবানী তিনি নিজের জীবনেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা তার আঁকা কার্টুন দেখলেই বোঝা যায়। যদিও সবগুলো তার সংগ্রহে নেই, যা আছে সেগুলি মিলিয়ে কোন সংকলন প্রকাশ করলে বা প্রদর্শনীর আয়োজন করলে নতুন প্রজন্মের কার্টুনিস্টরা উপকৃত হবে, কিছু জানতে পারবে বলে আমার ধারণা।

প্রথম প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৮
পুস্তকারে গ্রন্থিত: স্বপ্ন নয় ভাবনা, ২০১১, সিড়ি প্রকাশন

 

আরও দেখুন

এ বিষয়ের আরও সংবাদ

Close