সারাবাংলা
সুন্দরবনজুড়ে ফের দস্যু আতঙ্ক
ডেস্ক নিউজ: সুন্দরবন-সংলগ্ন জনপদের অন্য শিশু-কিশোরের মতো শৈশবেই বনে মাছ শিকার শিখেছেন আব্দুল জলিল। এ পেশার আয়েই সংসার চালিয়ে আসছেন এতদিন। গত কয়েক মাসে তাঁর জীবনের দৃশ্যপট বদলে গেছে। খুলনার কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা গ্রামেই পরিবার নিয়ে থাকেন জলিল। সোমবার তিনি বলছিলেন, ‘কষ্ট হলিও দিনমজুরি কইরে খাব, ডাকাতির মাইর খাতি আর বাদায় যাইব না।’
জলিলের মতো শত শত জেলের মধ্যে ভর করেছে ডাকাত-আতঙ্ক। এসব বনদস্যু গত এক মাসে অর্ধশতাধিক জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। এ সময় টাকা আদায়ের জন্য তারা জিম্মিদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। এ কারণে বহু জেলে এখন বনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কেউ ভ্যান চালিয়ে, কেউ দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন।
সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের আড়ুয়া শিবসা এলাকা থেকে ৪ জানুয়ারি দস্যুরা তুলে নিয়ে যায় একই গ্রামের জেলে আবু মুসাকে (৩০)। তারা পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এ তথ্য জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে নিজ বাড়িতে লুটিয়ে পড়েন আবু মুসার বাবা আব্দুল জব্বার। অচেতন অবস্থায় তাঁকে নেওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। চিকিৎসক জানান, পথেই হৃদরোগে মারা গেছেন জব্বার। গতকাল বুধবার পর্যন্ত বনদস্যুর কবল থেকে মুক্তি পাননি তাঁর ছেলে আবু মুসা।
স্বজনেরা জানিয়েছেন, ২ জানুয়ারি আবু মুসা সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে অনুমতি নিয়ে মাছ ধরতে যান। ৪ জানুয়ারি আড়ুয়া শিবসা থেকে তাঁকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চায় দস্যুরা। এ ঘটনায় ‘মামা-ভাগনে বাহিনি’ নামের একটি বনদস্যু চক্র জড়িত বলে জানিয়েছেন তারা।
৬ নম্বর কয়রা গ্রামের রজব আলী ও রিয়াজুল ইসলাম নামের দুই সহোদরসহ পাঁচ জেলে সুন্দরবনে অপহরণের শিকার হন ২৭ ডিসেম্বর। এতে জড়িত রবিউল বাহিনির সদস্যরা মুক্তিপণ হিসেবে দেড় লাখ টাকা দাবি করে। তারা রিয়াজুলকে জিম্মি রেখে রজব আলীসহ অন্যদের ২ জানুয়ারি ছেড়ে দেয়। টাকা জোগাড় না হওয়ায় বনদস্যুদের কবল থেকে রিয়াজুলকে ছাড়াতে পারছেন না স্বজনরা।
সোমবার ওই গ্রামেই কথা হয় মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। ১০ বছর ধরে সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছেন এ জেলে। বনদস্যুর ভয়ে এখন ভ্যান চালাচ্ছেন তিনি।
মফিজুল বলেন, ‘কয়েক বছর বাদায় ডাকাতের কোনো উৎপাত ছিল না। এখন আবার শুরু হয়েছে। বাদায় ঢুকলি দুই-তিন পার্টির টাকা দিতি হয়। না হলি লোক তুলে নিয়ে নির্যাতন করে। তাদের দাবি মতো টাকা দিতি গেলি জাল-দোড়া বেচলিও সম্ভব হয় না। বাড়ির জাগা-জমিও নেই যে তা বেচে ডাকাতির টাকা দেব। তাই বাধ্য হয়ে ভ্যান চালাতিছি।’
স্বামীর মৃত্যুর পর বনের ওপরই নির্ভরশীল আকলিমা খাতুন। এখন বনদস্যুর ভয়ে সুন্দরবনে যেতে না পারায় সংসার অচল এই নারীর। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে বলে জানালেন আকলিমা।
এক মাসের মধ্যে বনদস্যুর কবল থেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের বেশ কয়েকজন জেলে। তাদের মধ্যে রজব আলী, ইমামুদ্দীন, মকবুল গাজীসহ অন্তত দশজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিম্মিদশা থেকে মুক্তির জন্য তাদের সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত দস্যুদের দিতে হয়েছে। এই জেলেদের সবারই বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) রয়েছে। তাদের অভিযোগ, দস্যুদের পেছনে ইন্ধন দিচ্ছেন কিছু অসাধু মাছ ব্যবসায়ী। তারা সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকার খাল নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ কাজে জড়িত। সুন্দরবনে যাওয়ার আগে এসব মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি সারতে হয় জেলেদের। গোনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বনে ঢুকতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে শত শত জেলে সুন্দরবনে যেতে পারছেন না। এতে তাদের পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে।
সুন্দরবন-সংলগ্ন আরও কয়েকটি গ্রামের জেলেরা জানিয়েছেন, এক মাস ধরে সুন্দরবনে ৪টি দস্যু বাহিনী আধিপত্য বিস্তার করছে। তারা পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এর মধ্যে ‘মামা-ভাগনে বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত শরীফ ও মাসুমের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাকোপ উপজেলার আওতাধীন শিবসা এলাকা। মজনু ও রবিউলের বাহিনী কয়রা উপজেলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার একাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ফিরে আসা জেলেরা জানিয়েছেন, প্রতিটি বাহিনীতে ১০-১২ জন সদস্য রয়েছে। তাদের সবাই আগ্নেয়াস্ত্রধারী।
কয়রা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আকবর হোসেন এ বিষয়ে বলেন, সুন্দরবনে হঠাৎ করে দস্যুতা বেড়ে যাওয়ার মাছ আহরণ কমেছে। জিম্মি হওয়ার ভয়ে জেলেরা বনের খালে ঢুকতে পারছেন না। বনদস্যুদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে সুন্দরবনকেন্দ্রিক ব্যবসায় ধস নামবে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দীন বলেন, সুন্দরবনে ফের বনদস্যুদের আনাগোনো বেড়ে যাওয়ায় জেলে-বাওয়ালিরা আতঙ্কিত। অনেকেই সুন্দরবনে যেতে পারছেন না। এক মাসে সুন্দরবনে অন্তত ৫০ জন জেলেকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। এ মুহূর্তে বনদস্যুদের নির্মূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
এসব তথ্য জেলেদের মাধ্যমে পেয়েছেন সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক শরিফুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সব ফরেস্ট স্টেশন ও টহল ফাঁড়িগুলোকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হতে পারে। এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
সূত্র: সমকাল