ফিচার

রায়েদা

বাউল ঘরামি

পর্ব-১.
“বিন্নি ধানের খই আর মৌল ধানের মুড়ি
কনকচূড়ের মোয়ার জেনো নেই কোন জুড়ি।
অসুখ-বিসুখে কবিরাজশাল পথ্যেত গোবিন্দভোগ
ভূতমুড়ি ধানে সারে রক্তাল্পতা রোগ।”
“খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?…..”
“পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা
সঙ্কেত,
সবুজে হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের
ক্ষেত।……….
মোর ধানক্ষেত, এইখানে এসে দাঁড়ালে
উচ্চ শিরে,
মাথা যেন মোর ছুঁইবারে পারে সুদূর
আকাশটিরে!……..”
(জসীম উদ্দীন)
“শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের খেতে;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান, ……….. ”
(জীবনানন্দ দাশ)

বাংলাদেশ এবং ধান – যেন একে অপরের অভাবপূরক। কৃষি প্রধান এ দেশে ধানই প্রধান ফসল। হাজার হাজার বছর আগে থেকে ভাত আমাদের প্রধান খাবার- ‘মাছে ভাতে বাঙালি।’ কোথায় নেই ধান? মাঠে ধান, বিলে ধান, নৌকায় ধান, গাড়িতে ধান, ঘাটে ধান, উঠোনে ধান, গোলায় ধান, কবিতায় ধান! গ্রামীণ জনপদে যার যত বেশি ধান, তিনি ততো বড় মহাজন। ঐশ্বর্যের প্রতীক ধান। কেবলই খাদ্যের যোগান দেয় তাতো নয়, ধান বেচে কৃষক সংসারের সারা বছরের নানাবিধ ব্যয় নির্বাহ করে, ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয়। হজ্ব পালন কিংবা গয়া-কাশি গমন তাও ঐ ধানের বদৌলতে। ছোটবেলা আমরা এলাকার খেয়া পারাপারের মূল্য পরিশোধ করতাম মৌসুম ভিত্তিতে এককালীন ধান প্রদানের মাধ্যমে। ধানই বাঙালির জীবন।
হ্যা, আজকের প্রসঙ্গ বাংলার ধান। আগেই বলে নেয়া ভালো যে এ লেখার মধ্যে তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক উপযোগিতা খুঁজে ফেরা ঠিক হবে না। বিজ্ঞানও এখানে অনুপস্থিত। এ দেশের হাজার হাজার জাতের ধান, যা আজ বিলুপ্ত এবং তাদের বিচিত্র সব নাম লেখকের মনে এক ধরনের ‘অতীত-আর্ত’ ভাবের সঞ্চার করেছে। এতটাই সক্রিয় এবং গতিশীল যে তা অফুরন্ত অলস সময়ের সঙ্গী হয়ে ‘কাজ নাই তো খৈ ভাজ’ ধরনের কিছু একটা করতে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। গৌরচন্দ্রিকা অনেক হলো, এবার শুরু করা যাক।

পর্ব-২.
প্রায়দশ হাজার বছর আগে চীন এবং জাপানের সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম ধান চাষ শুরু হয়। পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৪০% এর খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয় ধান থেকে। বাংলাদেশে ধান চাষ শুরু হয় প্রায় ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে। রায়েদা/রায়েন্দা নামের একটি ধানকে দেশের প্রথম ধান বলে ধরা হয়। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে (খুলনা) এটি প্রথম পাওয়া যায়। স্পষ্ট মনে পড়ে ছোটবেলা রায়েন্দা, বাঁশিরাজ, গড়েশ্বর, দীঘা, রাজাশাইল ইত্যাদি ধানের নাম অনেক শুনেছি, আমাদের জমিতেই এর চাষ হতো। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়।
একটি সময় ছিল যখন এ দেশে হাজার হাজার বাহারি নামের দেশি জাতের ধানের আবাদ হতো। বিশিষ্ট ধানবিজ্ঞানী ডক্টর হেক্টর কর্তৃক ১৯৩৯ সালে পরিচালিত এক গবেষণা মতে এ দেশে ১৮ হাজার স্থানীয় জাতের ধানের চাষ হতো। সত্তরের দশকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে সারা দেশে পরিচালিত জরিপে প্রায় সাড়ে বারো হাজার স্থানীয় জাতের ধানের নাম পাওয়া যায় (রিপোর্ট প্রকাশ হয় ১৯৮২ সালে)। একই জাতের নাম স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হবার কারণে প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে কম হবার কথা। তবে গবেষকগণের অনুমান কম করে হলেও দেশে আট হাজার দেশি জাতের ধানের আবাদ হতো। এত এত ধানের সমাহার ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটির যথার্থতা আবারও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রবাদে বাঙালির হাজার বছরের পরিচয়কেই তুলে ধরা হয়েছে।
আমাদের ধানের নামগুলো বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। নামগুলো এত নান্দনিক আর অর্থবহ যে আমাদের পূর্বপুরুষদের নান্দনিকতাবোধকে স্যালুট করতে মন চায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাদের ছিল না বা তারা অনগ্রসর ছিলেন এ কথা বিশ্বাস করতেও আজ কষ্ট হয়। কোনো কোনো ধানের বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ নামের মধ্য দিয়েই প্রকাশ হয়ে পড়তো। যেন নামেই গুণের প্রকাশ। ফুল, ফল, ফসলের নামের সাথে মিল রেখে ধানের নাম। ঋতু, নানা বস্তু, এমনকি মাছের নামেও রয়েছে ধানের নাম। সবজি, পাখি, পশু, নদীর নামেও ধানের নাম। স্থান বা মানুষের নামও বাদ যায় নি। বীজের আকৃতি বোঝাতেও নামকরণ হয়েছে ধানের। এমকি বারের নামও আছে। অনেক আদুরে নামও রয়েছে সে তালিকায়।

পর্ব-৩.
সুগন্ধি ধানঃ ঠাকুরভোগ, দয়ালভোগ, বাদশাভোগ, সুলতানভোগ, সবরিভোগ, গোপালভোগ, রাজভোগ, রাজভোগশাহী, গোবিন্দভোগ, রসুলভোগ, সীতাভোগ ইত্যাদি আরও কত মনকাড়া নাম।
ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক রাসুল (সাঃ) বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কখনও পদার্পণ করেন নি। তাতে কী, এ দেশের কোনো ভক্ত অনুসারী তাঁকে আপ্যায়নের কথা মনে মনে ভাবতেই পারেন। রাসুল (সাঃ) এর জন্য আয়োজিত যথোপযুক্ত মেহমানদারীতে বাজারের সেরা চালটাই যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অতএব ধানের সেরা জাতটিকেই যে ‘রসুলভোগ’ নাম দেয়া হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই। অমনধারা নামকরণ থেকে রাসল (সাঃ) এর প্রতি এ দেশের মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বিষয়টি বুঝতে একটুও অসুবিধা হবার কথা নয়। ঠাকুর, সীতা, গোপাল বা গোবিন্দকে যে ভোগ আনন্দের সাথে ভক্ত নিবেদন করে থাকেন তা যে অতি উত্তম চালের ভোগ তা সহজেই অনুমেয়। রাজা বা সুলতানকে কোর্মা-পোলাও দিয়ে আপ্যায়নের চাল যে ধান থেকে পাওয়া যায় তার নাম রাজভোগ বা সুলতানভোগ হবে সেটাই তো স্বাভাবিক!
ভোগ ছাড়াও অন্য নামকরণের মাধ্যমেও সুগন্ধী ধানের গুনকীর্তন প্রকাশিত হয়েছেঃ রাঁধুনিপাগল, বৌসোহাগী, জামাইনাড়ু, বৌপাগলা ইত্যাদি।
পোলাও রাঁধতে গিয়ে রাঁধুনী গন্ধে পাগল হয়ে গেলে সে জাতের ধানের নাম রাঁধুনীপাগল ছাড়া আর কি-ই বা হতে পারে! বৌ এর হাতে রান্না করা পোলাও-কোর্মা খেয়ে স্বামী যখন বৌকে পাগলের মতো আদর-ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় তখন সে ধানের জাতকে ‘বৌপাগলা’ নাম না দিলে যে বড় অবিচার হয়!
অধিক ভালোবাসা বা স্নেহ থেকে প্রদত্ত নামঃ লক্ষ্মীলতা, দুলাল, লক্ষ্মীবিলাস, দুধসাগর, সোহাগ, কাঁচাননী, দুধসর, চন্দ্রহার।
আবেগ স্নেহ মমতা ভালোবাসা মেশানো নাম এগুলো। কেবলই ধান বা একটি ফসল নয় যেন। প্রিয়তমা স্ত্রী, আদরের ভাইবোন কিংবা কলিজার টুকরো সন্তানদেরই যেন সেখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এ দেশে যে এককালে সন্তানআদরে ফসলের পরিচর্যা করা হতো তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে!

পর্ব-৪.
এ প্রসঙ্গে আমার ছোটবেলার একটা স্মৃতি শেয়ার না করলেই নয়। আজ থেকে অন্তত ৪০ বছর আগের কথা। আমাদের ছোটবেলার গ্রামের পশ্চিম-দক্ষিণ দিক জুড়ে ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের নমশূদ্রপাড়া। সেই পাড়ায় শ্রীযুক্ত মদন মালাকার নামে এক বৃদ্ধ ছিলেন, দাদা বলে ডাকতাম তাকে। অনেক স্নেহ করতেন আমাকে। ছোটখাটো ছিপছিপে গড়নের দাদার বয়স তখন ৯০/৯৫। প্রাণশক্তিতে ভরপুর দাদা সারাদিন ডাঙায় কাজ করতেন, ক্লান্তি যেন ভয়ে তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতো! পানের আবাদ, মসলার আবাদ থেকে শুরু করে এমন কোনও ফসল নাই যার চাষ তার হাতে হয় নি। তখনকার দিনে আমাদের গ্রামে এত বহুমুখী ফসলের চাষাবাদ হতো না। সে অর্থে এটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী বা অভিনব ব্যাপার। প্রত্যেকটা ফসল ও উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ তিনি সবিস্তারে বলে যেতেন এবং সকলকে তা চাষে উদ্বুদ্ধ করতেন। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা তার ছিল না। স্বশিক্ষিতই বটে! তো সেই দাদার একটা নেশা ছিল গ্রামের সরু রাস্তার দু’পাশে তালগাছ রোপণ করা। তখনকার দিনে তালগাছ মূল্যবান বৃক্ষের মর্যাদা পেত। “দু’পাশে তালগাছের সারি রেখে হারিয়ে যাবো বলে হেঁটে চলেছি তো চলেছি, পথের যেন শেষ নেই, আমিও থামবো না পণ করেছি”- এমন স্বর্গীয় অনুভূতি লাভের সৌভাগ্য আমার সেই ছোটবেলায় হয়েছে দাদার বদৌলতে। আজ এই ভেবে অবাক হই যে শ্রীযুক্ত মদন মালাকার দাদার পরিবার আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল ছিল, ছেলেরা সকলেই কর্মক্ষম। একান্নবর্তী পরিবারের একই চুলোয় একই পাতিলে সকলের রান্না হতো। ঐ বয়সে তো দাদার শুয়ে-বসে আরামে কাটানোর কথা। অথচ দিনরাত তিনি হয় নতুন ফসল বপন/রোপণ কিংবা ফসলের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করতেন। কীসের নেশা? উনি কি ঐ বয়সেও নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পেতেন ফসলের মাঠে? নাকি সে উনার হৃদয় নিংড়ানো প্রেম বাংলা মায়ের ফুল-ফসলের অনুকূলে? হাজারো মহাপ্রাণ শ্রীযুক্ত মদন মালাকারদের স্নহ-মমতা প্রেম-ভালোবাসার উত্তরাধিকারই বর্তমানের কৃষি ব্যবস্থা তথা আজকের বাংলাদেশ।
ফুলের নামে ধানঃ জবাফুল, মরিচফুল, সূর্যমুখী, বাঁশফুল, কদমফুল, কামিনী, নয়নতারা, লেবুফুল ইত্যাদি।
বাঁশগাছেও ফুল হয়, তবে সমতলে তা বিরল বা দৈবাৎ হয়ে থাকে। শুনেছি পাহাড়ের বাঁশঝাড়ে ফুলের দর্শন সহজে পাওয়া যায়। সীমাহীন কৌতুহল নিয়ে দুরন্ত কৈশোরে অসংখ্য বাঁশবাগানে গিয়েছি বাঁশফুলের খোঁজে। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেলেও সে ফুল দেখার সৌভাগ্য আমার কভু হয় নি। জীবনে হাজারো অপূর্ণতার মাঝে এটিও একটি। বাঁশফুলের অপূর্ণতা নিয়েই হয়তো পৃথিবী থেকে একদিন অজানা গন্তব্যের দিকে ধাবিত হবো। যা হোক, একটি টাইমমেশিন পেলে আজ হাজার বছর আগে ফিরে গিয়ে উত্তরাধিকারী পরিচয়ে ঋষিতুল্য আমার সেই পূর্বপুরুষগণ এর মুখোমুখি হতাম। দত্তের দোকানের সন্দেশ আর বাগাটের দই সহকারে বড় একটা প্রণাম ঠুকে ‘বাঁশফুল’ ধানের নামকরণের গোপন রহস্যটা জেনে নেয়া যেত তা হলে।

পর্ব-৫.
ফলের নামযুক্ত ধানঃ লিচু, জামরুল, কামরাঙা, ডুমুর, বাদাম, মরিচপাল, নারিকেলবেদী, খেজুরঝোপা ইত্যাদি।
লিচু, জামরুল, কামরাঙা, ডুমুর ইত্যাদি নামের ধানের কথা বলা হলে আজকের প্রজন্মের কেউ কেউ মূর্ছা গেলেও অবাক হবার কিছু আছে কি? তারপরও এটিই সত্য যে বাহারি মজাদার রসালো সব ফলের নামে আমাদের অনেকগুলো ধানের নামকরণ হয়েছিল।
সবজির নামযুক্ত ধানঃ কুমড়া, বেগুন, হাসিকুমড়া, কুমড়াগৈর, ষাটকুমড়া,আশাকুমড়া।
নিশ্চিতভাবে জানার সুযোগ আজ আর অবশিষ্ট নেই, তবু ধারণা করি ‘কুমড়া’ নামের ধানটি দেখতে অনেকটা কুমড়ার মতো নাদুসনুদুস গোছের ছিল। মনে পড়ে ছোটবেলা আমরা সমবয়সীদের বিভিন্ন নাম বা উপাধি দিয়ে দুষ্টুমির মজা নিতাম। মোটা বা ভারী শরীরের অনেককেই ‘গণেশ’ বা ‘ঢ্যাপসা’ নামে ডাকা হতো। কোনোরূপ হিংসা-বিদ্বেষ থেকে উদ্ভূত নয়, কেবলই নিষ্পাপ মনের বিশুদ্ধ আনন্দ লাভ। বাংলার ধানের মতো আমাদের সেই সব নির্মল আনন্দ লাভের উপায় এবং উপকরণসমূহ আজ চিরতরে বিলুপ্ত।
ফসলের নামে ধানঃ পানবর, মরিচাবুটি, মরিচাডুলি, সোনামুগ, বাদাম, মরিচপাল, কাঁচাহলুদ, তিলবাযাল, খৈয়ামটর।
জামাই বা বরকে শ্বশুর বাড়িতে ভুঁড়িভোজের মাধ্যমে আপ্যায়নের রেওয়াজ বাঙালি সমাজে আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। ভোজনশেষে সুগন্ধি বাহারি পানে ডালা সাজিয়ে বরের সামনে উপস্থাপন অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। বর মিষ্টি পান মুখে পুরে নববধূ এবং শ্যালক-শ্যালিকাদের সাথে হাসি-তামাশায় মেতে উঠবে এমনটাই সকলে প্রত্যাশা করে। সেই বাহারি পান এবং বরের সম্ভাব্য সুখকর রসায়নকে মাথায় রেখে ধানের নাম ‘পানবর’ রাখা হয় নি কে বলবে!

পর্ব-৬.
বৃক্ষের নামে ধানঃ বট, বাগতুলসি, পাথরকুচি, বাঁশপাতা, বটশাইল, কেওড়া।
বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পাতলা এবং ধারালো গড়নের কারণেই ধানটির নাম ‘বাঁশপাতা’! কিন্তু ‘বট’ বৃক্ষের কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো মাথাই নষ্ট হবার জোগাড় হলো বুঝি এবার!
শাক, পোকা, ঔষধিগাছ এবং মশলার নামে ধানঃ কচু/কঁচু, মৌমাছি, ঘৃতকাঞ্চন, এলাচি।
‘এলাচি’ না বোঝা গেল, কিন্তু ‘কচু’ বা ‘মৌমাছি ‘? কোনো বিরক্তিকর গুণাবলির কারণেই কি এমন নামকরণ?
মাছের নামে ধানঃ কৈঝুরি, রুই, কইয়াবোরো।
‘মাছে ভাতে বাঙালি’, অতএব বিশেষ বিশেষ মাছের প্রতি একটু বেশি আবেগ ভালোবাসার প্রকাশ ভিন্নভাবে ঘটবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
পশুর নামেঃ গয়াল, বকরি, বকরিমাথা, শিয়াললেজী, মহিষবাতান, বুড়াহরিণ, মহিষদল, হনুমানজটা, হরিণকাজলি, মহিষপাল।
পরকাল বা পরজন্মে আমার মহান পূর্বপুরুষগণ এর সাথে সাক্ষাৎ হবে বলে আশা পোষণ করি। সেদিন ধানের নাম গয়াল বা মহিষপাল হবার রহস্য জেনে নিতে একটুও ভুল হবে না। কথা দিলাম।

পর্ব-৭.
পাখির নামে ধানঃ ঘুঘুশাইল, চড়ুই, ময়না, বকফুল, মাছরাঙ্গা।
উল্লিখিত পাখিগুলো গ্রামবাংলার জীবনে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে, যার বহিঃপ্রকাশ ধানের মাঝেও প্রবিষ্ট হয়েছে।
মানুষের নামে ধানঃ মইরম/মরিয়ম, নিপা, মানিক, মোড়ল, কবির মনি, ফুলমতি, মানিক মণ্ডল, কামাই মল্লিক, কাঞ্চন বিবি ইত্যাদি।
শ্রদ্ধা, ভক্তি, পছন্দ কিংবা ভালোবাসা থেকে আমাদের সমাজে সন্তানাদির নাম রাখার প্রচলন বহুদিনের পুরোনো। রুচিভেদে ধর্মীয়-মনীষী, রাজা-বাদশা, কবি-সাহিত্যিক প্রভৃতি নাম এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। ধানের নামকরণেও যে কখনও কখনও এমনটা ঘটে নি তা দিব্যি দিয়ে বলা যায় কি? অথবা এমনও হতে পারে যে এই মানুষেরাই ধানের জাতগুলো আবিষ্কার করেছিলেন। নিকট অতীতে ঝিনাইদহে আবিস্কৃত ‘হরি’ ধানকেও এ তালিকায় রাখা উচিত।
স্থানের নামে ধানঃ বটেশ্বর, ভাউয়াল, হাতিয়া, পটুয়াখালী, ফরাসডাঙ্গা, লক্ষ্মীপুরা, ময়নামতি।
সংখ্যায় ধানঃ বাইশ বিশ, আড়াই, বাইশ ।
দেশী জাতের ধানের সংক্ষিপ্ততম নামটি এক অক্ষরেরঃ ‘নি ‘।

পর্ব-৮.
বর্ণের উপর ভিত্তি করে ধানের নামঃ কালোবকরি, কালোকচু, কালাসোনা, কালামানিক, কালাবোয়ালি, কালাষাইট্টা, কালোপাহাড়, কালোচিনা, কালোকুমারী, সাদাকলম, লালএমন, লালআউশ, সিঁদুরকোটা, দুধশাইল, ধলাষাইট্টা, দুধসর, কৃষ্ণজিরা ইত্যাদি।
কালো, সাদা, লাল, সবুজ প্রভৃতি গাঢ় রং সমূহ আমরা ভালো বুঝতে পারি এবং বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষ করে বাঙালি পুরুষের গায়ের রং এর সাথে কালো রংটা বেশ যায়। সে কারণে এ সব বর্ণের নামে ধানের নামকরণ হতেই পারে।
নদীর নামে ধানঃ গঙ্গাসাগর, মধুমতি ইত্যাদি।
গঙ্গা বা মধুমতি নদীর পাড়ে যাদের বসবাস তাদের মনে বিলুপ্ত এ ধানের জাত দুটো অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি করবে তা অনুমান করা যায়। যেমনটি আমার মনে হচ্ছে।
কোন্ মাসে ধান পাকে তার ওপর ভিত্তি করে ধানের নামঃ আশ্বিনা, কার্তিকদুল, কার্তিকশাইল, আশ্বিনীকান্দি, আশ্বিনিনা, বৈশাখী, চৈতা ইত্যাদি।
ধানী মৌসুমের নামযুক্ত জাতঃ সোনালীবোরো, কালিবোরো, চন্দনবোরো, শাইলবোরো, টেপিবোরো, জংলিবোরো, খৈয়াবোরো, লালবোরো ইত্যাদি।
শাইল নামযুক্ত অনেক ধান রয়েছেঃ আগুন শাইল, শওকত শাইল, জাবর শাইল, লোনা শাইল, বাঁশ শাইল, মেদি শাইল, মাধব শাইল, কাচি শাইল, এনা শাইল, গুয়া শাইল, কাতি শাইল, মধু শাইল, কামিনী শাইল, রাই শাইল, আমশা শাইল, জিংগা শাইল, পানি শাইল, ভুট্টা শাইল, পুটি শাইল, ইঁদুর শাইল, কাইদ শাইল, গাবরা শাইল, আনি শাইল, মুকুট শাইল, মাগুর শাইল, পশু শাইল, চুল শাইল, দারকা শাইল, ভোতরা শাইল, শনি শাইল, সোনা শাইল, ঢেঁকি শাইল, ভাসা শাইল, শুং শাইল, ঝুপড়ি শাইল, বোঁটা শাইল, আশানি শাইল, বিহারী শাইল, রঘু শাইল, মানিক শাইল, মাধব শাইল, কলমী শাইল, কচু শাইল, নিদান শাইল, পিপড়া শাইল, বুচা শাইল, ডাকিয়া শাইল, লোরা শাইল, বোটা শাইল, আম শাইল, কুমড়া শাইল, ঝিংগা শাইল, আতা শাইল, কালা শাইল, ওকরা শাইল, গরুয়া শাইল, টেপী শাইল, আতপ শাইল, বৈরাগী শাইল, গন্ধি শাইল ।
শাইল/শালি শব্দের আভিধানিক অর্থ সুগন্ধি হৈমন্তিক ধান্য। অতএব বলা যায় এগুলো সব হেমন্তকাল তথা আমন মৌসুমের ধান।

পর্ব-৯.
বাংলাদেশের লোকজ উৎসব পালিত হবে, সেখানে বিন্নি ধানের খৈ থাকবে না তাও কি সম্ভব! বিন্নি ধানের খৈ আর বাতাসা ছাড়া কোনো মেলা-পার্বণ এ দেশে হয় নি। সেই বিন্নি ধানের নামেও রয়েছে বৈচিত্র।
নানা নামের বিন্নি ধানঃ চন্দন বিন্নি, মধু বিন্নি, খরা বিন্নি, বাংলা বিন্নি ইত্যাদি।
বিন্নি ছাড়াও খৈ তৈরির আরও জাতঃ খই ,খইয়া ইত্যাদি।
আবেগ-ভালোবাসায় মন ছুঁয়ে যায় এমন আরও কয়েকটি ধানের জাতঃ মধুমালা, জলকুমারী, ঝড়াবাদল, মধুমালতী, কনকচূড়, আয়নামহল, চাঁদমনি, ময়ূরকন্ঠি, হাসিকলমী ইত্যাদি।
বীজের আকার ছোট তাই নাম হয়েছেঃ বেগুনবীচি, ক্ষুদেবরণ।
চিকন বীজের ভিত্তিতে নামঃ সরু বা চিকন, লালচিকন, বাদাইচিকন, চিকনধান, সাদা চিকন।
অনুমান করা যায় বীজের আকার বড় হওয়ায় নাম হয়েছেঃ বাইশমনি, চৌদ্দমুগুর।
জাতির নামেঃ বাঙালি, ফরাসি, বাঙালিন, তুর্কি।
নামের সাথে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না এমন নামের ধানঃ সরষেবানর, আল্লাবক্সি, চার্নক, ডেপর, কারাইল, লেজা, গর্চা, ভাষা, খাবলি।
‘সরষেবানর’ নামটা শৈশবে শুনতে পেলে কী মজাই না হতো! আমার শৈশবের বন্ধু এবং খেলার সাথী, গায়ের রং যাকে বলে হলদেটে ফর্সা, কিন্তু মুখটা ছিল পোড়া পোড়া, অনেকটা বান্দর সদৃশ! বুঝতেই পারছেন ‘সরষেবানর’ নামটির কত সুন্দর একটা প্রয়োগ আমার হাতছাড়া হয়েছে!

পর্ব-১০.
তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত বহনকারী নামের ধানঃ শনি, সরষে বানর, বাঙাল দাড়ি, পশু।
ধানের এমন নামকরণের কারণ অনুমান করাও কঠিন। ধারণা করা যায় এদের গুণের পাল্লা বড়ই হালকা।
কয়েকটি ধানের নাম ‘চালাকি’ বা ‘চপল’ বা ‘বলদা’ কিংবা ‘মুসলিম’ কেন তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়।
কোনও ধানের নাম কেনইবা ‘গোরা’ বা ‘গম্ভীর’ কিংবা ‘সাধু’ সেটিও কম ভাবনার বিষয় নয়।
‘গাঁজা’ নামের ধানের জাতটিতে কোনো মাদকতা ছিল কি?
জীবনে একবার গাঁজা সেবনের সুযোগ হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, এসএসসি পরীক্ষার একটু আগে বা পরে আমার প্রাণের বন্ধু তোতার কৃপায় ওদের বাড়ির দোতলায় বসে। সিগারেটের ভিতরের ‘শুকো’ (তামাক) আস্তে আস্তে চেপে চেপে ফেলে দিয়ে সেখানে আগে থেকে কুচিকুচি করে রাখা গাঁজা আস্তে আস্তে প্রবেশ করাতে হয়। গাঁজা ঢুকানোর পর সিগারেটটি পুনরায় পূর্বের আকার প্রাপ্ত হয়। বিষয়টিকে আমার কাছে বেশ শৈল্পিক এবং উপভোগ্য মনে হয়েছিল। শিল্প বিষয়ক সব কৃতিত্বই তোতার, আমি দর্শক মাত্র। যা হোক, গাঁজা সেবনের জন্য প্রস্তুত এবার। সিগারেট সবাই সাধারনত যার যার হাতেরটা টানে। কিন্তু গাঁজা সেবনের কায়দাকানুন ভিন্ন। লোক সংখ্যা যা-ই থাক, গাঁজা কিন্তু একটাই ধরানো হবে এবং সেটিই একজন থেকে আরেকজন এভাবে হাত বদল হতে থাকবে। যার হাতে যাবে সে একটান মেরে পাশের জনকে হস্তান্তর করবে। এভাবে ক্রমাগত হাতবদল আর ছেদহীন টানে একটা শেষ হবে, তারপর আরেকটিতে অগ্নিসংযোগ করা হবে। এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে গাঁজা সেবনের প্রক্রিয়া চলমান থাকে। সেদিন তোতা এবং আমি সম্ভবত ৩/৪টি গাঁজা ভর্তি ফিল্টার ওয়ালা সিগারেট শেষ করি। এর পর পরই তোতা আমাকে ঘর থেকে দানাপড়া ঝোলা খেজুরের গুড় এনে দেয়। গুড় খাবার পর নেশা যেন তুঙ্গে উঠে গেল। আমি আর জমিনে নেই, আকাশে পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে চলেছি। যা দেখছি, যা কিছুই শুনছি সবই ভালো লাগছে, স্বপ্নের মতো! সেদিন গাঁজা সেবনের পর প্রাণ খুলে উচ্চস্বরে এত হেসেছিলাম যে মনে হয় আমার সারা জীবনের হাসির যোগফল তার সমান হবে না। যা হোক, ধানের নাম ‘গাঁজা’, মনে একটা খটকা থেকেই গেল!

পর্ব-১১.
কী অন্তর্নিহিত গুণ থাকার কারণে ধানের নামকরণ ‘বৈরাগী’ বা ‘খেয়ালী’ হয়েছিল তা আজ রীতিমতো গবেষণার বিষয়।
‘পাগলি’ নামের জাতটি কৃষকের বাড়তি আবেগ-ভালোবাসা পেয়ে জীবনটাকে ধন্য করে নিয়েছে বলা যায়।
‘বৌ পালানী’ নামটি মন্দ স্বভাবের ইঙ্গিত বহন করে বলে আন্দাজ করা যায়। আমরা তো জানি গৃহস্থ ঘরের বৌ সহজে পালাবে না। তবে কি অন্যবিধ কিছুর ইঙ্গিত বা গন্ধ আমরা পাচ্ছি?!
বেশকিছু ধান যে কেবল পানিতে জন্মায় তা তাদের নাম শুনলেই ধারণা পাওয়া যায়, যেমন- ‘জল’, ‘জালি’, ‘পানিশাইল’, ‘সোনামলিজল’ ‘দিঘা’ ‘ধলাদিঘা’, ‘আশ্বিনাদিঘা’ ইত্যাদি।
একই জাতের হলেও এলাকাভেদে নাম কিছুটা পাল্টে যেত, যেমন- ‘লোনাশাইল’/’নোনাশাইল’, ‘রাধুনি পাগল’/’রান্ধুনি পাগল’, ‘নারিকেলবেদী’/’নারিকেলপদী’, ‘চিনিগুড়ি’/’চিনিগুড়া’, ‘বৌপাগলা’/’বৌপাগল’ ‘মাটিচক’/’মতিচক’, ‘কৈয়াঝুড়ি’/’কৈঝুরি’ ইত্যাদি।
‘পাজাম’ ধানটি পাকিস্তান আমলে এ দেশে আনা হয়। ধানটির জন্মস্থান জাপান। কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ধানটির নাম দেয় পাজাম। পাকিস্তানের পা জাপানের জা এবং মালয়েশিয়ার ম দিয়ে পাজাম নাম হয়েছে।
ভেষজগুণ সম্পন্ন ধানঃ এক সময়ে পূর্ববাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু জায়গায় ‘ভূতমুড়ি’ নামে একটি ধানের ব্যাপক চাষাবাদ হতো, যার ভেষজ গুণ অতুলনীয়। ‘ভূতমুড়ি’ চালের ভাত শরীরের রক্তস্বল্পতা রোগ সারায়।, অর্থাৎ এ ভাত খেলে শরীরে রক্তের পরিমান বৃদ্ধি পায়। আগেকার দিনে গ্রামবাংলার গর্ভবতী মহিলাদের সন্তান প্রসবের আগে-পরে ভূতমুড়ি চালের ভাত খেতে দেওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল। ভূতমুড়ি ধানের চাষ বাংলাদেশে এখন আর হয় না, তবে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কয়েকটি অঞ্চলের পুরনো দিনের কিছু মানুষ বংশপরম্পরায় এখনও সীমিত আকারে ধানটির চাষ করছেন।

পর্ব-১২.
‘কবিরাজশাল’ নামে একটি ধান এককালে গ্রামবাংলায় সত্যই কবিরাজের ভূমিকা পালন করতো। অপুষ্টি, অরুচি, ক্ষুধামান্দ্য, রক্তস্বল্পতাসহ নানাবিধ অসুখে খুবই কার্যকর এ ধানটির ভাত। এই কবিরাজশালও প্রায় বিলুপ্তির দ্বারে। বাংলাদেশে এর চাষ অনেক আগেই উঠে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের পূর্বমেদিনীপুরের কিছু নিচু অঞ্চলে খুবই সীমিত আকারে এর চাষ হচ্ছে।
একটি বিরল জাতের ধানের নাম ‘দুধের সর’ বা ‘দুধসর’। ২০০৯ সালের আয়লার পর সুন্দরবনের অতিরিক্ত লবণাক্ত অঞ্চলে মাঠের সব ধরনের ধান নষ্ট হয়ে গেলেও এই দুধের সর জাতটি দিব্যির বেঁচে যায়।
যুগল, গৌরনিতাই, লবকুশ এ তিনটি নামই একটি ধানের, এলাকাভেদে নামে এ ভিন্নতা এসেছে। শুনলে অবাক হতে হয় যে এর একটি ধানের মধ্যে দুটো চাল! যুগল ধানের ফলন অধিক, উফশী জাতের মতোই। অসাধারণ এই জাতটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলাদেশে এর নাম শোনা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের কিছু নিবেদিতপ্রাণ চাষি অনেক যত্নে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন এই দুর্লভ জাতটিকে।
এক বিস্ময়কর ধানের নাম ‘সতীন’, যা আজ পুরোপুরি বিলুপ্ত। প্রকৃতি সত্যি খুবই অদ্ভূত খামখেয়ালিপনায় পরিপূর্ণ! সতীন জাতের একটি ধানের মধ্যে তিনটি চাল থাকে- একটি বড় আকৃতির চাল, তার দু’পাশে দুটো ছোট চাল! বড় চালটি স্বামী, ছোট দুটো তার স্ত্রী! একই ঘরে (খোসা) স্বামীর সাথে দুই সতীনের সুখের সংসার! আমাদের সমাজে সতীনের সংসার মানেই অশান্তির আগুন। আমরা মানুষ বলেই হয়তো জীবনে অনেক কিছু মেনে নিতে পারি না। সতীনের সংসার ধারণাটি আমাদের সমাজে অনেকটা অরুচিকর। আইনও অনুকূল নয়। তা সত্ত্বেও সংখ্যায় কম হলেও আমাদের সমাজে সতীনের সংসার ছিল, আছে। আফ্রিকার কিছু দেশে পুরুষের একাধিক বিয়ে উৎসাহিত করা হয়। আগের দিনের রাজা-বাদশারা অগুনিত স্ত্রী গ্রহণ করতেন। এর বাইরে হাজারো উপপত্নী এবং রক্ষিতারা হেরেমকে আলোকিত করে রাখতো। রাজা স্বয়ং এবং যুবরাজগণ সময়ে সময়ে হেরেমের অন্দরমহলে প্রবেশ করে সুন্দরী রমনীদিগের সান্নিধ্য লাভ করে মনটাকে চাঙ্গা করে নিতেন। রাজকার্য বলে কথা, মনটা ফুরফুরে না থাকলে তা কি সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়! অত আগে যাবার দরকার কী? ভুটানের রাজা মহোদয়ইতো আপন দুই বোনকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে দিব্বি রাজকার্য চালিয়েছেন। তা হলে আমরা একটু অগ্রসর হয়ে ভেবে নিতে পারি যে, মানুষ জাতির মতো, বিশেষ করে রাজা-বাদশাদের দেখাদেখি কোনও কোনও উদ্ভিদের (যেমন সতীন জাতের ধান) মনেও একাধিক স্ত্রী সহকারে জীবনযাপনের খায়েশ জেগে থাকে! অনেকটা হেঁয়ালি বা রসিকতা হয়ে গেল, কিন্তু যাকে নিয়ে এত কথার অবতারণা সেই সতীন ধানটি আজ বিলুপ্ত।

পর্ব-১৩.
শিল্প-সাহিত্য জীবনের কথা বলে। বাঙালির জীবন আর বাঙালির ধান অনেকটা সমার্থক। অতএব বাংলা সাহিত্যে বাংলার ধান্য স্থান পাবে না তা কি হয়? সেখানেও ধান্য তার নাম বৈচিত্র নিয়ে হাজির! কালিদাস থেকে আধুনিককাল সবখানেই ধানের গুণকীর্তন দৃশ্যমান। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এ ক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে আছে।
মধ্যযুগের বাঙালি কবি রামাই পন্ডিত রচিত শাস্ত্রীয় গ্রন্থ ‘শূন্যপূরাণ ‘ এ আশিটি ধানের নাম আছেঃ আজান, আন্ধারকুলি, আমপাবন, আমলো, আলোচিত, আসঅঙ্গ, আসতির, উড়াসালি, ককাচি, কনকচুর, কাঙদা, কামদা, কালাকাত্তিক, কালাযুগর, কুসুমমালি, কোটা, খিরকম্বা, খেজুরছড়ি, খেমরাজ, গআবালী, গন্ধতুলসী, গন্ধমালতি, গুজুরা, গোতমপলাল, গোপালভোগ, চন্দনশালী, ছিছরা, জলারাঙ্গি, জেঠ, জোলি, ঝিঙ্গাসাল, টাঙ্গন, তসরা, তিলসাগড়ি, তুলসানি, তুলানধান, তোজনা, দলাগুরি, দাড়, দুধরাজ, নাগরজুগান, পর্বতজিরা, পলাল, পাঙ্গুসিয়া, পাতন, পাথরা, ফেফেরী, বককড়ি, বন্ধি, বাঁকই, বাঁকচুর, বাঁকশাল, বাঁজগজা, বাঁশমতি, বাগনবিচি, বালি, বিন্ধশালী, বুখি, বুরামত্তা, বোআলি, ভজনা, ভাদোলী, ভাদ্দমুখি, মইপাল, মাধবলতা, মুক্তাহার, মুলা -মুক্তাহার, মৌকলস, লতাকো, লাউসলী, লালকামিনি, সনাখড়কি, সালছাটি, সীতাশালী, সোলপনা, হরি, হরিকালি, হাতিপাঞ্জর, হুকুলী।
‘শূন্যপূরাণ’ ১২০১-১৩৫০ সময়কালের মধ্যে রচিত বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। বাংলা তখন দখলদার মুসলিম শাসকের অধীনে। এ সময়টায় বাংলা সাহিত্য চর্চায় এক ধরনের বাধা বা স্থবিরতা নেমে এসেছিল এ কথা সত্য। মুসলিম দখলদারিত্বের দিকে অঙ্গুলি তুলে এ সময়টাকে অনেকেই বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে থাকেন। এ ব্যাপারে আরও নিরপেক্ষ গবেষণা আবশ্যক বলে মনে হয়। কারণ মুসলিম দখলদারিত্বের অব্যাবহিত পূর্বে পাল শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেনদের শাসন কায়েম হয়েছিল বাংলায়। অর্থাৎ মুসলিম আগমনের আগে থেকেই বৌদ্ধ এবং হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন বিদ্যমান ছিল। তার সাথে নতুন যুক্ত হলো বিদেশি মুসলিম শাসক। শুরু হলো একটি ত্রিমুখী মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। যা হোক, এমন একটি বিরূপ পরিস্থিতিতেও কিন্তু মধ্যযুগে সংখ্যায় কম হলেও বেশ কিছু কালজয়ী সাহিত্য রচিত হয়।
লক্ষ্য করার মতো যে ‘শূন্যপূরাণ’ এ উল্লিখিত প্রথম ধানটির নাম ‘আজান’। আজান/আযান কথাটি ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত, অর্থ ‘ঘোষণাধ্বনি’। আজান কি এবং কেন তা সকলেরই জানা। বর্তমান যুগে শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছেয় তাদের অনুকূলে নামকরণ হয়ে থাকে তা আমরা জানি। সেই মধ্যযুগেও কি একই ধারা অব্যাহত ছিল? নাকি বিষয়টা এমন যে কোনো মুসলিম কৃষক ধানটির আবিষ্কার করে এমন নামকরণ করেন? নামকরণের পিছনের ঘটনা আমরা হয়তো আর কোনোদিন জানতে পারবো না। আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো- সেই মধ্যযুগ বা তার আগে থেকেই বাঁশমতি চালের অস্তিত্ব আছে। বর্তমান যুগে বাঁশমতি চাল সবার কাছেই একটি কাঙ্ক্ষিত বস্তু এবং এ কারণে তা উচ্চমূল্য ধারণ করে আছে।

পর্ব-১৪.
মধ্যযুগের আরেকটি গ্রন্থ ‘শিবায়ন’ এ উল্লিখিত ধানের নামঃ কটকী, কনকচুর, কনকলতা, কলমীলতা, কপোতকন্ঠিকা, কয়াকচ্চা, কামোদ, কার্তিকা, কালিন্দী, কালিয়া, কাশীফুল, কুমুমশালী, কৃষ্ণশালী, কেলেকানু, কেলেজিরা, কোঙরভোগ, কোঙরপূর্নিমা, ক্ষেম, খয়েরশালী, খেজুরথুপি, গঙ্গাজল, গন্ধমালতি, গয়াবলি, গুণাকর, গুয়াথুপি, গোপালভোগ, গৌরীকাজল, চন্দনশালি, চামরঢালি, ছত্রশালী, ছিঙ্গাশালি, জগন্নাথভোগ, জটাশালী, জলারাঙ্গী, তিলসাগরী, দারবঙ্গী, দুধরাজ, ধুস্ত্তর, নছিপ্রিয়, নন্দনশালী, নিমই, পর্দেশী, পতলাভোগ, পয়রারস, পিপীড়াবাঁক, পুণ্যবতী, বলাইভোগ, বাঁকচুর, বাঁকশালী, বাকোই, বুড়ামাত্রা, বুয়ালি, ভবানীভোগ, ভোজন, রঙ্গয়কড়ি, রাঙ্গী, রামগড়, রামশালী, লক্ষ্মীকাজল, লাউশালী, সীতাশালী, হরকুলি, হরিশঙ্কর, হলুদগুড়া, হাতিপাঞ্জর, হাতিপাদ, হিঞ্চি, হুড়া।
এ যুগের সাহিত্যেও নানাভাবে ধানের প্রসঙ্গ এসেছে। কবি ফররুখ আহমেদ এর নাম এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। কেবল ধানের বাহারি নাম নিয়ে তার একটি কবিতা আছেঃ
“কুমারী, কনকতারা, সূর্যমুখী, হাসি কলমি আর
আটলাই, পাশপাই ধান -এ পাক বাংলার মাঠে মাঠে ।
আউষ ধানের স্বপ্নে কিষাণের তপ্ত দিন কাটে ;
আমনের বন্যা আনে ফসলের সম্পূর্ণ জোয়ার ।
শোকর গোজারী ক’রে তারপর দরবারে খোদার
গোলায় তোলে সে ধান- রূপসা তিলক কাচারী,
বালাম, খিড়ায়জালী, দুধ-সর মাঠের ঝিয়ারী
কৃষাণ পল্লীতে আনে পরিপূর্ণ মুখের সম্ভার।”
(প্রথম আট লাইন)
উফশী ও হাইব্রিড ধানের দাপটে দেশি জাতের ধান চাষ বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। হাজার হাজার জাত ইতোমধ্যে বিলুপ্ত। গবেষণা করে উন্নত ও কাঙ্খিত জাতের ধান উদ্ভাবনের জন্য দেশি জাতের জিন প্রয়োজন হয়। দেশি জাতের ধানের ভাত সুস্বাদু ও সুগন্ধি। দেশি জাতের ধান চাষে সার ও সেচ কম লাগে। পোকামাকড় রোগবালাই এর আক্রমণ কম হয়। এ সব কারণে এর উৎপাদন খরচও কম। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বিধায় উফশী এবং হাইব্রিড জাতের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সম্মত। বাজারে এখনও দেশি জাতের চালের চাহিদা এবং দাম দুটোই বেশি। বাসমতি, কালিজিরা, পাইজাম, নাজিরশাইল, বিরই প্রভৃতি নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। তবে দেশি জাতের নেতিবাচক দিক এর উৎপাদন কম। উফশী ধানের উৎপাদন খরচ বেশি ফসলের দাম কম। আমাদের চাষের জমি সীমিত, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতেই উফশী জাতের আবাদ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশি জাতের ধান ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা দেশের কল্যানে হারানো মানিক বাংলার ঐতিহ্য বিলুপ্ত ধানকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কয়েক হাজার দেশি জাতের ধানের বীজ এখনও জিন ব্যাংকে সংরক্ষিত আছে। সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে আবারও তাদের বাংলার কৃষকের হাতে তুলে দেবার সুযোগ আছে। মনে রাখা দরকার যে বিলম্ব বেশি হলে অনেক কিছুই হাতছাড়া হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
(৭ মে ২০২০)

আরও দেখুন

এ বিষয়ের আরও সংবাদ

Close