অস্থিরতা আবার ফিরে এসেছে ইউরোপে। সামাজিক অস্থিরতা, রাজনীতিতে গভীর বিভাজন ও দ্বন্দ্ব, অর্থনীতিতে সংকট এবং শাসক এলিট ও জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থা সংকটময় পর্যায়ে পৌঁছেছে। নব্য উদারতাবাদী অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের ফসল এই সংকট। আর তা বেশ কয়েকটি দেশে জনগণের মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও হতাশা জন্ম দিয়েছে। দেশগুলো হলো ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ইতালি ও গ্রিস। সংকটগুলোর আন্তর্জাতিক শিরোনাম এ রকম: অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক অস্থিরতা ও অভিবাসন সমস্যা, সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ ও প্রাণহানি, ব্রেক্সিট নিয়ে জটিলতা, ফ্রান্সের গণ-আন্দোলন। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে দক্ষিণপন্থীদের আশঙ্কাজনক উত্থান।
৫০ বছর ক্ষমতায় আছে ইউরোপের প্রচলিত ডান-বাম ও উদারপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। এখন তারা পরিবর্তিত ভূমিকায় কার্যত নব্য উদারতাবাদী পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করে যাচ্ছে। এর ফলে জনগণের মধ্যে এদের আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। ইউরোপে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ ব্যাপক হয়েছে। স্পষ্ট হচ্ছে, মানুষ আর এই নব্য উদারতাবাদী বিশ্বায়িত পুঁজিবাদ মেনে নেবে না। লোকরঞ্জনবাদী দক্ষিণপন্থী জাতিরাষ্ট্রের ধারণা ইউরোপে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের দেশে দেশে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সাংগঠনিক শক্তির বৃদ্ধি ঘটিয়ে ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করে চলেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঁচ বছর আগেও যাদের অবস্থান প্রান্তসীমায় ছিল, সেসব দক্ষিণপন্থী ও ডান ঘরানার লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক দল আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রায় প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান। দৈনন্দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শুধু নয়, পার্লামেন্টেও তারা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। ইতালি, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডে এই দক্ষিণপন্থী দলগুলো হয় সরকার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে অথবা সরকারের অংশ হিসেবে কোয়ালিশনে রয়েছে। এদের শক্তিবৃদ্ধি ও মূলধারার রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াটা এখন আর কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। বরং তাদের এই শক্তিবৃদ্ধি, ইউরোপজুড়ে পরিকল্পিতভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তি সামনের দিনগুলোয় তাদের শক্তি আরও সংহত করার পূর্বাভাস বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন।
দক্ষিণপন্থীদের এই উত্থানের কারণ দুটি: এক. পরাশক্তিগুলোর দ্বারা সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও অভিবাসী সংকট এবং দুই. তাদেরই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়া। এ ছাড়া বিশ্বায়নের করাল গ্রাসে জাতীয় পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি ভীতিও দক্ষিণপন্থীদের বিজয়কে সম্ভব করছে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক আকাঙ্ক্ষাগত পার্থক্য থাকলেও তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অভীপ্সা প্রায় এক। আর তা হলো একটি সংযুক্ত ইউরোপ গড়ে তোলা, যা হবে স্বাধীন এবং মুক্ত জাতিগুলোর একটি ফেডারেশন। আর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাদের সবার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে কসমোপলিটন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এলিট, নব্য উদারনীতির সমর্থক ও মদদপুষ্ট গণমাধ্যম এবং ব্রাসেলসে ইইউয়ের আমলাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান শত্রু হলেন জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও ফ্রান্সের এমানুয়েল মাখোঁ। কারণ, এই দুজন বর্তমানে বিকাশমান জাতিরাষ্ট্রের পুনর্জাগরণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পুরোনো বহুপক্ষীয় ও মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে ইউরোপীয় সমন্বয়ের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নব্য উদারতাবাদী বিশ্বায়িত পুঁজিবাদ কর্তৃক গত ৩০ বছরের সৃষ্ট সংকট ও দাভোস এলিটদের হাত থেকে ইউরোপের মানুষ পরিত্রাণ পেতে চাইছে। এর পাশাপাশি ইউরোপীয় দেশগুলোর বিভিন্ন প্রচলিত ডেমোক্রেটিক, রক্ষণশীল ও উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো যারা নব্য উদারতাবাদী বিশ্বায়িত করপোরেট পুঁজিবাদ ও দাভোস এলিটদের স্বার্থ রক্ষা করে যাচ্ছে, তাদের ওপরও জনগণের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। সুতরাং ইউরোপজুড়ে এ ধরনের রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা ও নির্বাচনী ভবিষ্যৎ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোয় সাম্প্রতিক নির্বাচনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, লিবারেল ও নানা কিসিমের বামদের ব্যাপক পরাজয় ও দক্ষিণপন্থীদের রাজনৈতিক উত্থান এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। ইউরোপের শাসকগোষ্ঠী জনগণকে বোঝাতে সচেষ্ট হয় যে তারা অতি ডান রাজনৈতিক শক্তির বিপক্ষে, কিন্তু কার্যত বাম প্রগতিশীল শক্তির উত্থানের চেয়ে ডান শক্তিকেই মদদ দিয়ে থাকে। এদের সমর্থনপুষ্ট গণমাধ্যম ডান শক্তির বিরোধিতার নামে পরোক্ষে এদের উত্থানের পেছনে ভূমিকা রাখছে।
তবু বলতে হয়, আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইউরোপজুড়ে ডান ও অতি ডানপন্থী পার্টিগুলো বিভিন্ন দেশে নির্বাচনী সাফল্যও অর্জন করে চলেছে। ফিনল্যান্ডের দ্য ফিনস ১৮, সুইডেনের সুইডেন ডেমোক্র্যাটস ১৭ দশমিক ৬, ডেনমার্কের ডেনিশ পিপলস পার্টি ২১, জার্মানির অলটারনেটিভ ফর জার্মানি ১২ দশমিক ৬, চেক রিপাবলিকের ফ্রিডম অ্যান্ড ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি ১১, অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টি ২৬, নেদারল্যান্ডসের ফ্রিডম পার্টি ১৩, ফ্রান্সের র্যাসেম্বলমেন্ট ন্যাশনাল ১৩, সুইজারল্যান্ডের সুইস পিপলস ২৯, স্লোভাকিয়ার আওয়ার স্লোভাকিয়া ৮, বুলগেরিয়ার ইউনাইটেড প্যাট্রিয়টস ৯, হাঙ্গেরির জোবিকের ১৯, ইতালির দ্য লিগের ১৭ দশমিক ৪, সাইপ্রাসের এলামের ৩ দশমিক ৭ ও গ্রিসের গোল্ডেন ডন পার্টির ৭ শতাংশ সমর্থন ও ভোট রয়েছে।
এ ছাড়া ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসে দক্ষিণপন্থীদের ১০ থেকে ২০ শতাংশ জনসমর্থন ও ভোটব্যাংক রয়েছে। কয়েক বছর ধরে এই সমর্থন বেড়ে চলেছে। পর্যবেক্ষকদের অভিমত, এই বছরের মে মাসের ২৩ থেকে ২৬ তারিখে অনুষ্ঠেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি নির্বাচনে ইইউবিরোধী দক্ষিণপন্থী দলগুলো ব্যাপক বিজয় লাভ করবে। বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে ইতিমধ্যে দক্ষিণপন্থীদের জনপ্রিয়তা ঊর্ধ্বমুখী। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও মধ্য ডান রক্ষণশীল দলের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ৭৫১ আসনের ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ৫৪ শতাংশ সিট দখল করে থাকা সেন্টার লেফট ও সেন্টার রাইটদের যে মহাজোট, তাদেরই ৪০০ পার্লামেন্ট সদস্য বর্তমানে ইইউ নিয়ন্ত্রণ করছে। মহাজোটের এই নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন ডানপন্থী দলের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য থাকলেও অভিবাসন, ইউরোপে ইসলাম ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরোধিতা এবং ইউরোর বিরোধিতা ইস্যুতে একমত হয়ে এরা ইউরোপীয় অ্যালায়েন্স তৈরি করবে। ইতালির মাত্তেও সালভিনি খোলাখুলি বলেছেন, এবারের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন হবে বিপজ্জনক শ্রম, অভিবাসন, লগ্নিপুঁজি, ব্যাংক ও এলিটদের ইউরোপ বনাম জনগণের এবং শ্রমিকদের ইউরোপের মধ্যকার নির্ধারক গণভোট। পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা সঠিক প্রমাণিত করে দক্ষিণপন্থীরা ব্যাপকভাবে বিজয়ী হলে ইইউয়ের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা কী হবে, সে ব্যাপারে কারোরই সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। তা জানতে আমাদের ঘটনা ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
পিয়াল রহমান: নেদারল্যান্ডসে বসবাসকারী অ্যাকটিভিস্ট