জাতীয়
বিএনপি জামায়াত এনসিপি পদ্ধতি নিয়ে মত দেয়নি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়ার বিষয়ে একমত রাজনৈতিক দলগুলো। কোন পদ্ধতিতে প্রবাসীরা ভোট দিতে পারবেন, সে বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল তাদের মতামত জানায়নি। তারা দলীয় ফোরামে আলোচনার পর নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে। মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘ভোটিং সিস্টেম উন্নয়ন’সংক্রান্ত সেমিনারে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এ মতামত জানান। ওই সেমিনারে আগামী ১৫ মের মধ্যে দলগুলোকে মতামত দিতে অনুরোধ জানিয়েছে ইসি।
সেমিনারে প্রবাসীদের ভোটদানের প্রস্তাবিত তিনটি পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ ও ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হয়। এতে পোস্টাল ও অনলাইন ভোটিংয়ের চেয়ে প্রক্সি পদ্ধতি তুলনামূলক সহজ ও বাস্তবভিত্তিক হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। যদিও এ পদ্ধতিতে কিছু ঝুঁকি ও ত্রুটির কথা তুলে ধরে কয়েকটি দল। তাদের এসব বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীন রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার আশ্বাস দেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের সুযোগ দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা চান।
সেমিনারে সমাপনী বক্তব্যে সিইসি বলেন, আমরা সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণ করার চেষ্টা করছি। আপনাদের মতামতকে গুরুত্ব দেব। আমরা কনফিডেন্ট, আমরা শুরুটা করতে চাই। আপনাদের সহযোগিতা, বিশেষ করে দলগুলোর সমর্থন চাই। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল হচ্ছে আমাদের প্রধান স্টেকহোল্ডার। ভবিষ্যতে আপনাদের দাওয়াত দেব; ইনশাআল্লাহ আপনারা আসবেন। আপনাদের মতামতের জন্য এবং সর্বোপরি নির্বাচনের জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।
এর আগে উদ্বোধনী বক্তব্যে এএমএম নাসির উদ্দীন বলেন, আপনাদের পরামর্শ নিয়েই আমরা এগোতে চাই। আর সর্বোপরি, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যদি সমর্থন না দেন, আমাদের যত এক্সারসাইজ আছে-ইট উইল অল অ্যান্ড ইন ফিউটিলিটি।
আগামী নির্বাচনে ছোট পরিসরে হলেও প্রবাসীদের ভোটিং চালু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে সিইসি বলেন, আমরা চাই পরবর্তী নির্বাচনে অন্তত শুরু করতে চাই। অন্তত যাত্রা শুরু হোক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শুরু করে আবার এগোতে পারেনি। অনেক দেশ চালু করেছে, অনেক দেশ চালু করতে পারেনি। আমরা চালু করতে চাই, অন্তত সীমিত পরিসরে শুরু করতে চাই। আমরা চাই নেক্সট ইলেকশনে শুরু হোক, আপনাদের সমর্থন চাই। আশা করি সমর্থন পাব।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার দিতে পোস্টাল, অনলাইন ও প্রক্সি-এই তিন পদ্ধতির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে ইসি। এ বিষয়ে মতামত নিতে গতকাল এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় ২১টি দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এছাড়া সুশীল সমাজ, সিনিয়র সাংবাদিক, কারিগরি বিশেষজ্ঞরাও উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারের শুরুতে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, বিভিন্ন দেশে এক কোটি ৩৩ লাখের বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছেন। তাদের ৭০-৮০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের বেশি। বাংলাদেশের মোট ভোটারের ১০ শতাংশ প্রবাসী। তাদের ভোটাধিকারের সুযোগ দেওয়া না হলে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক বলা যায় না।
প্রবাসীদের ভোটাধিকারে সুযোগ দেওয়ার পক্ষে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরেন দেশটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে যখন ইসি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আমরা প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগের প্রস্তাব করেছিলাম। ২০১৭ সালের ভিশন ২০-৩০, ২০২২ সালের ২৭ দফাতেও প্রবাসীর ভোটের কথা বলেছি। ২০২৩ সালের ৩১ দফার রাষ্ট্র সংস্কারের সময়ও এই বিষয়টি বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। প্রবাসীদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার উদ্যোগের প্রতি বিএনপির পূর্ণ সমর্থন আছে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের পদ্ধতির বিষয়ে বিএনপির এ নেতা বলেন, আমরা দলীয়ভাবে আলোচনা করে মতামত দেব। কোন পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো হয়, সেই মতামত দেব। এই দুনিয়ায় কোনো সিস্টেমই ফুলপ্রুফ নয়। ফুলপ্রুফ হলে সংস্কার, বিপ্লবের প্রয়োজন হয় না। আমরা বিবেচনা করব সবচেয়ে যেটা সহজ, বোধগম্য হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে সবচেয়ে যেটা গ্রহণযোগ্য হবে, যেটা সবচেয়ে সাশ্রয়ী হবে সেই প্রক্রিয়ার প্রতি আমরা সম্মত হতে পারব বলে আশা করি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমরা ইসির সঙ্গে বৈঠকে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি এনেছিলাম। ইসি সেই উদ্যোগ নিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনের ওপর গত ১৫ বছরে বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে হবে।
প্রক্সি পদ্ধতিতে কিছু ত্রুটি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এক্স একজনকে প্রার্থীকে পছন্দ করেন, ওয়াই আরেকজনকে পছন্দ করেন। তাহলে এক্স-এর প্রক্সি যদি ওয়াইকে দেওয়া হয়, তাহলে ভোটারের রায়ের সঠিক প্রতিফলন হবে না। তবে দলীয় ফোরামে আলোচনার পরই পরবর্তী সময়ে মতামত দেওয়া হবে। আমরা বিশ্বাস করি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে। কোনো অবস্থাতেই সিস্টেমকে ডেসট্রয় করা যাবে না।
প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতিতে ত্রুটি রয়েছে জানিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ইসির কাছে আমাদের প্রত্যাশা যেন অর্ধেক নয়, পরিপূর্ণ এফোর্ট দিয়ে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারে। প্রক্সি ভোট হলে কোথাও কোথাও অনেক ভোট পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে এটা একটা থ্রেট হতে পারে। আমরা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে ভোটের পদ্ধতির বিষয়ে ইসিকে আমাদের মতামত জানাব। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো ট্রাস্ট বা বিশ্বাস। ইসিকে এটা বজায় রাখতে হবে। অনলাইন হোক বা পোস্টাল পদ্ধতি হোক সবার যাতে ট্রাস্ট থাকে, সেই বিষয়টি জরুরি। প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতি নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে প্রবাসীদের ভোটিং পদ্ধতি সম্পর্কে ইসিকে জানাব।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, প্রক্সি ভোটে ভোটার যাতে পছন্দ করেন, তার পক্ষেই যেন ভোট পড়ে, সেই নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা ভেবে দেখতে হবে। এবি পার্টির শ্যাডো অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি আব্বাস ইসলাম খান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বেশির ভাগ প্রবাসীর এনআইডি আছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশে থাকা অনেক প্রবাসীর এনআইডি নেই কিন্তু পাসপোর্ট আছে। তাই এনআইডি না থেকে পাসপোর্ট থাকলে তার ভিত্তিতে ভোটের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান। তিনি জানান, এনআইডির ডাটা নিরাপত্তা দিতে পারিনি। তাই অনলাইন ভোটিংয়ে পাবলিক ট্রাস্ট নিয়ে আসতে হবে। কেননা শুরু করে সিকিউরিটি দিতে না পারলে বন্ধ হয়ে যাবে। অনলাইনে যেহেতু হ্যাক করা যায়, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার এলে কী হবে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া প্রক্সি ভোট বাংলাদেশের জন্য খুব রিস্কি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, প্রবাসে দেড় কোটি ভোটার, এর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে আছে। সতর্কতার সঙ্গে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। তাই ইসির উচিত দলগুলোকে আস্থায় এনে যেন কমিশন পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়। নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার জানান, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যেন ভুল না হয়। আস্থা ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান প্রক্সি ভোটের পক্ষে তার দলের অবস্থান জানান।
যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, দেশ থেকে পালিয়ে গেছে তারা যেন কোনোভাবেই অনলাইনে ভোট দিতে না পারে, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডিয়াম মেম্বার লে. জেনারেল (অব.) ড. চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী।
তবে বাংলাদেশ কংগ্রেস ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট প্রক্সি ভোটের বিপক্ষে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন।
সেমিনারে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ, বেগম তাহমিদা আহমদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার ও ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।