জাতীয়
নির্বাচনের সময় নিয়ে অসন্তুষ্টই থাকতে হচ্ছে বিএনপিকে

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবির প্রতি আপাতত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সম্মতি আদায় করতে পারেনি বিএনপি। এ নিয়ে হতাশা চেপেও রাখেনি দলটি। ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি গণমাধ্যমকে বলেছে, বৈঠকের ফলাফলে তারা একেবারেই সন্তুষ্ট নয়।
তবে নির্বাচন কোনোভাবেই ২০২৬ সালের জুনের পরে যাবে না– সরকারের দিক থেকে বিএনপিকে বারবার এমনটি আশ্বস্ত করা হয়েছে। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও সাংবাদিকদের তা-ই বলেছেন; ব্যাখ্যা করেছেন কারণও।
গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পৌনে দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করে উভয় পক্ষ। দুপুর সোয়া ১২টায় এ বৈঠক শুরু হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি চলতি বছরের জুন-জুলাই মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল। তখন প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছিলেন। বিএনপি তাতে আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু পরে সরকার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা জানায়। তার পর থেকে বিএনপি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা এবং নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানায়। সম্প্রতি নির্বাচন নিয়ে নানামুখী কথা শুরু হলে বিএনপি সরকারের সঙ্গে আবার বসার সিদ্ধান্ত নেয়।
গতকালের বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ছিলেন।
সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
বিএনপির সূত্র জানায়, তাদের পক্ষ থেকে বৈঠকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রমজান, তারপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং এর পর বর্ষাকাল শুরুর কথা স্মরণ করিয়ে ডিসেম্বরের পর নির্বাচন করা কঠিন বলে মত দেওয়া হয়। জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে তিনি নির্বাচনের তারিখ ঠিক করবেন। কোনোভাবেই জুন পার করবেন না।
বৈঠকে নির্বাচনী রোডম্যাপ, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বিএনপি একেবারেই সন্তুষ্ট নয়। প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচনের সময়সীমার কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে চান। আমরা তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) বক্তব্যে একেবারেই সন্তুষ্ট নই। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি– ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, তা আরও খারাপের দিকে চলে যাবে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে।’
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং করণীয় নিয়ে একটি লিখিত প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরা হয়। সেখানে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ওই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, তারা ফ্যাসিস্ট এবং তাদের দোসরদের বিচার ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান না করা পর্যন্ত নির্বাচন দিতে পারছেন না। খুব শিগগির এসব কার্যক্রমকে দৃশ্যমান করার উদ্যোগ ত্বরান্বিত করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয় বিএনপি নেতাদের।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, নির্বাচনের জন্য ১৮ মাস যথেষ্ট সময়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের যে গতি, সংস্কারের যে গতি, তাতে নির্বাচন নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। যেসব সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য হবে, তার মধ্যে যেসব সংস্কার নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন, সেগুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। বাকিগুলো জুলাই সনদ হিসেবে থাকবে। সেই সনদ বাস্তবায়নের জন্য যারাই ক্ষমতায় আসবে, তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু সংস্কার ও বিচারের দোহাই দিয়ে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা উচিত হবে না।
বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা না বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। সেখানে কোনো সমস্যা থাকলে বিএনপি প্রয়োজনে সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। তারা ট্রাইব্যুনাল ও প্রসিকিউশন টিমে লোকবল সংকট, যথেষ্ট তদন্ত টিম না থাকায় সময়ক্ষেপণ হচ্ছে বলে জানান।
এ পর্যায়ে বিএনপি প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য বলেন, যদি নির্বাচন নিয়ে আরও সময়ক্ষেপণ করা হয় তাহলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির ঝুঁকি থাকবে। পতিত সরকারের দোসররা সক্রিয় হবে। তারা ষড়যন্ত্রের সুযোগ পাবে। আবার অনির্বাচিত সরকারের লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বিএনপি শুধু নির্বাচনের স্বার্থেই নির্বাচন চায় না; গণতন্ত্রের জন্য, দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে এবং গণঅভ্যুত্থানের যে প্রতিশ্রুতি, তা বাস্তবায়নে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে।
বিএনপি নেতারা বলেন, দেশের মানুষ বিগত ১৬ বছর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। সেই অধিকার ফিরিয়ে আনতে বিএনপি আন্দোলন করেছে। ফ্যাসিবাদের পতনের পর চলতি বছরের জুন-জুলাই মাসের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছে বিএনপি। কিন্তু যখন প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছেন, তাতেও আশ্বস্ত হয়েছে বিএনপি। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতির সামনে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা এবং নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানায় বিএনপি। কিন্তু তার বিপরীতে সরকারের কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। একই সঙ্গে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কথাবার্তায় জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক ও গায়েবি মামলা নিরসন নিয়ে কথা বলেন বিএনপি নেতারা। বৈষম্যের শিকার ও পদোন্নতিবঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডারের ৭৬৪ কর্মকর্তাকে সচিবসহ বিভিন্ন পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হলেও তাদেরকে কোথাও নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে কী করবে বিএনপি– সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দলের ভেতরে এবং আমাদের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তারপর আমরা আবারও আপনাদের সামনে আসব।’
এদিকে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল অ্যান চুলিকের সঙ্গে গতকাল বিকেলে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। গুলশানে যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি হেড অব মিশনের বাসভবনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকেও আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবির কথা তুলে ধরে বিএনপি।
বৈঠক শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কোনোভাবেই আগামী বছরের জুনের পরে যাবে না। যে যা-ই বলুক না কেন; এটা পুরো জাতির কাছে প্রধান উপদেষ্টার অঙ্গীকার।
বিএনপির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে কিছু বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ইচ্ছা করে দেরি করে মে বা জুন মাসে নির্বাচন করা হবে, সেটা না। ডিসেম্বর থেকে জুন মানে হচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ডিসেম্বরে সম্ভব হলে ডিসেম্বরে, জানুয়ারিতে সম্ভব হলে জানুয়ারিতেই নির্বাচন হবে বলে বিএনপিকে বৈঠকে বোঝানো হয়েছে।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের কাছে জনগণের তো একটা আকাঙ্ক্ষা আছে, যেন আমরা দোষীদের বিচার করে যাই। বাংলাদেশে হাজারের বেশি তরুণ জীবন দিয়েছে, আর ৫০-৬০ হাজার মানুষ শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের বিচারের দাবি তো গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান আকাঙ্ক্ষা। সে ক্ষেত্রে আমরা বিচার না করে যদি নির্বাচন দিই, মানুষের কাছে জবাব দেব কীভাবে?’
সংস্কার নিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, জুলাই চার্টার (সনদ) প্রস্তুত হয়ে গেলেও আইনগত বিষয় আছে, নীতিগত বিষয় আছে। সেগুলো গ্রহণ করতে সময় লাগছে।
বিএনপি সংস্কারের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক বলে উল্লেখ করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব বিষয়ে দলটি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে তারা ঐকমত্য পোষণ করে।
আসিফ নজরুল বলেন, বিএনপি বলেছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করলে ভালো হয়। আমরা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যেটা বারবার বলেছেন, সেটাই সরকারের অবস্থান। সেখান থেকে অন্য কেউ যদি বেফাঁস কথা বা নিজস্ব বিবেচনায় কথা বলেন, সেটাতে তারা যেন বিভ্রান্ত না হন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক আজ বৃহস্পতিবার। সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদের এলডি হলে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে দলের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল থাকবে। গত ২৩ মার্চ ঐকমত্য কমিশনে সংস্কারের মতামত জমা দেওয়ার পর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।