সারাবাংলা
ডাকাত আতঙ্কে নৈশ বাসে কমছে যাত্রী

সাম্প্রতিক সময় নৈশ বাসে ডাকাতির ঘটনা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। যাত্রীবেশে বাসে উঠে চালক, সহকারী ও সুপারভাইজারসহ যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব ছিনতাই করে নিচ্ছে ডাকাতদল। এ অবস্থায় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-রাজশাহীসহ রাতে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসে যাত্রী কমছে। এ অবস্থায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাস মালিকরা। তারা জানিয়েছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের নৈশ সার্ভিস বাস বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই।
সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকাতদলের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় জড়িত। কেউ গার্মেন্টসে খণ্ডকালীন কাজ করেন। আবার কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন বা অটোরিকশা চালান। এরাই রাতের বেলা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। ফোন করে হুমকি দেন। নিয়মিত মাসোহারা না পেলে গাড়ি থামিয়ে লুট করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিবহন ব্যবসায়ী বলেছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, মদনপুর, কাঁচপুর, সোনারগাঁও ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঘোড়াশাল টোলপ্লাজা থেকে ইটাখোলা মোড় পর্যন্ত পয়েন্টে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। এদের নিয়মিত মাসোহারা দিতে হয়। কোনো কারণে একটু কমবেশি হলেই তারা হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করেন। নয়তো রাতে বাস থামিয়ে মালামাল লুট করে নিয়ে যান। অনেক সময় রাস্তায় কাঠের গুড়ি ফেলে ডাকাতির চেষ্টা করে। এ সময় বাস চালক গাড়ি থামাতে না চাইলে পাথর ছুঁড়ে বাসের সামনের কাঁচ ও জানালার কাঁচ ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ থেকে বগুড়ার শেরপুর এবং রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে শঠিবাড়ী পর্যন্ত বেশ কয়েকটি রাত্রিকালীন ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে।
এ ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা বলেন, সম্প্রতি মহাসড়কে বেশ কিছু ঘটনার পর চেষ্টা করা হচ্ছে ডাকাতির ঘটনা কমিয়ে আনার। গত তিন দিনে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। ইতিমধ্যে আমরা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবাসীদের জন্য একটি হেল্পডেক্স চালু করেছি। এই হেল্পডেক্স থেকে একজন প্রবাসী রাত্রিকালীন তার বাড়িতে যাওয়ার পথে হাইওয়ে পুলিশের অফিসারদের নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত একটি অ্যাপস চালু করা হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ রাত্রিকালীন মহাসড়কে ডিউটি করছে। এতে মহাসড়কে স্বল্প দূরত্বে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
সম্প্রতি বাস ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় যাত্রী সংখ্যা কমছে দাবি করে একজন বাস মালিক বলেন, গত দুই দিন রাতে ১৩ জন যাত্রী নিয়ে নীলফামারী থেকে সিলেট গেছে তার বাস। আর গতকাল রাতে এসেছে ১৪ জন যাত্রী নিয়ে। আগের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ যাত্রীও মিলছে না। আবার ঢাকা থেকে রংপুর বা রাজশাহীগামী বাসগুলোতে গড়ে ১০/১৫ জন যাত্রী কম নিয়ে যাতায়াত করছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, গত দেড় মাসে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছে। তবে সড়কে ডাকাতির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। ডাকাত আতঙ্কে রাতে দূরপাল্লার বাসের যাত্রী কমেছে। এ পরিস্থিতির জন্য যাত্রী ও সংশ্লিষ্টরা দায়ী করছেন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, টহল না থাকা ও ঢিলেঢালা নিরাপত্তাকে।
চট্টগ্রাম থেকে রংপুর আসার পথে কয়েক দিন আগে কালিয়াকৈর ব্রিজের কাছে ডাকাতির কবলে পড়ে মাসুদ পরিবহনের একটি বাস। ঐ বাসের সুপারভাইজার সাদ্দাম হোসেন জানিয়েছেন, চান্দুরায় চার জন যাত্রীবেশে উঠেছিল। কালিয়াকৈর ব্রিজের কাছে এসে সামনে একটি প্রাইভেটকার গতিরোধ করে। এরপর যাত্রী বেশে থাকা ডাকাতদলের সদস্যরা টাকা ও বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় ডাকাত সদস্যরা তাকে বেধড়ক মারধর করে। হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এক সপ্তাহ।
রংপুর থেকে ঢাকা নিয়মিত যাওয়া-আসা করেন শহরের কসমেটিকস ব্যবসায়ী আবুল কালাম। সম্প্রতি রাতে বাস ডাকাতির আতঙ্কে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন। কালাম জানিয়েছেন, আমি রাতে রংপুর থেকে ঢাকায় গিয়ে দিনের বেলা প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে আবার রাতের গাড়িতে ফিরে আসতাম। এখন রাতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
কুড়িগ্রাম-সিলেট রুটের ইউনাইটেড পরিবহনের সুপারভাইজার বাবুল বলেন, মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ক্যাম্প না থাকা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের স্বল্পতার কারণেই বেশির ভাগ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এসব কারণে রাতে বাসে যাত্রী কমছে।
গত ২৫ জানুয়ারি রাতে ডাকাতের কবলে পড়ে ঢাকা থেকে রংপুরের গঙ্গাচড়াগামী সৈকত পরিবহন। বাসমালিক আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাত দেড়টার দিকে কালিয়াকৈর ব্রিজ এলাকায় যাত্রীবেশে ওঠা আট জনের একটি দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা-পয়সা, মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ কারণে এখন রাতে বাস চলাচল ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যায় না।
পরিবহন সংশ্লিষ্টতা জানিয়েছেন, রাতে ডাকাত আতঙ্কে কমেছে যাত্রী সংখ্যা। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাস মালিকরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাস বন্ধ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।
জনবল ও যানবাহন সংকটে হাইওয়ে পুলিশ: মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও চাহিদা অনুযায়ী হাইওয়ে পুলিশের অপর্যাপ্ত জনবল এবং পরিবহন সংকটের কারণে যাত্রীরা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। হাইওয়ে পুলিশ বর্তমানে ৭৩টি থানা ও ফাঁড়ির মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে আসছে। ৩ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কে দিবা-রাত্রি মাত্র ২ হাজার ৮০০ পুলিশ ডিউটি করে। সম্প্রতি রাত্রিকালীন বাসে ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা পুলিশকেও যুক্ত করা হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের একটি ফাঁড়ি থেকে আরেক ফাঁড়ির দূরত্ব গড়ে ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার। এ কারণে রাতে মহাসড়কগুলোতে হাইওয়ে পুলিশের দুই ফাঁড়ির মাঝের দূরত্বে মহাসড়কে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের টহল দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।