আন্তর্জাতিক
ইউক্রেন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে ইউরোপীয় দেশগুলো?

ইউরোপের নেতারা বেশ বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়েছেন। সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) প্যারিসে তাদের পক্ষ থেকে অনেকটা তাড়াহুড়ো করে ডাকা নিরাপত্তা সম্মেলন অন্তত সেটাই প্রমাণ করে। ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র যে তাদের বাইরে রেখেছে, সেটা হয়তো তারা এখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারছেন না।
রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন যে তিনি খুব শিগগির রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হলো চাপের মুখে থাকা ইউরোপ কি তাদের নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উদ্বেগকে একপাশে সরিয়ে রেখে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যয় ও ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা ফ্রন্ট গঠন করতে পারবে? সেই সঙ্গে ইউরোপ কি ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর মতো পদক্ষেপ নিতে পারবে যা তাদের এই যুদ্ধের বিষয়ে আলোচনার টেবিলে একটা জায়গা করে দিতে পারে?
তবে এই বিষয়টা নিশ্চিত যে তারা একটা চেষ্টা করতে যাচ্ছে। সোমবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পাঠাতে যুক্তরাজ্য রাজি আছে এবং তাদের সেই প্রস্তুতিও আছে। এমনকি জার্মানিতে আসন্ন নির্বাচনের আগে সিডিইউ পার্টির পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক মুখপাত্র বলেছেন, আন্তর্জাতিক নিয়মরীতির মধ্যে থেকে তারা বিদেশে সৈন্য মোতায়েন করতে আগ্রহী। নির্বাচনে এই দল বেশিরভাগ আসন পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউক্রেনের বিষয়ে আসলে কী করা হবে, তা নিয়ে এখনো শতভাগ নিশ্চিত নয় ট্রাম্প প্রশাসন। সপ্তাহজুড়েই এ বিষয়ে তাদের মিশ্র বার্তা এসেছে।
এই আবহে ইউরোপের একটা ছোট্ট সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এই সুযোগের হাত ধরে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে যে ইউরোপও এই আলোচনায় একটা অমূল্য অংশীদার।
ইউরোপ আপাতত প্যারিস সম্মেলনে দুটি বড় ইস্যুর বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবছে যা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগেই দাবি জানিয়েছেন। প্রথমত ইউরোপ তার নিজস্ব প্রতিরক্ষার খাতে আরও ব্যয় করবে এবং যুদ্ধবিরতির পর তারা ইউক্রেনে সেনা বাহিনী পাঠাবে।
ইউরোপের নেতারা অবশ্য চাইছেন যে, যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত আলোচনায় কিয়েভকে সরাসরি জড়িত করা হোক। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে এসেছে যে, ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে ইউক্রেন সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
তবে ইউক্রেন সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনার সময় তাতে উপস্থিত থাকাটা ইউরোপের জন্য আরও বেশি জরুরি।
এ প্রসঙ্গে কঠিন বাস্তবটা সামনে এসেছে যে ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে বা তাদের (ইউরোপের) প্রতিরক্ষার বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয় না। এই উপলব্ধি ভয়ের হতে পারে কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিরাপত্তা বলয়ের উপর নির্ভর করে আসছে। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা কোনদিকে গড়ায় এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন সেটা নিয়ে কতটা উৎসাহিত বোধ করেন, সেটার সাথে সাথে ইউরোপের জন্য আরো একটা আশঙ্কাও জোরদার হয়ে উঠেছে যে,এসবের ফলে তাদের নিরাপত্তা কাঠামোই পরিবর্তন করতে হতে পারে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ঐতিহাসিকভাবে ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলের বিস্তারকে অপছন্দ করে এসেছেন। ফলে রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও সাবেক সোভিয়েত বাল্টিক রাষ্ট্র এবং পোল্যান্ড এখন অনিরাপদ বোধ করতে পারে।
সোমবার প্যারিসে আয়োজিত এই সম্মেলনে ইউরোপের সব দেশ অংশগ্রহণ করবে না। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড, স্পেন এবং ডেনমার্ক -এর মতো দেশ যাদের প্রতিরক্ষার দিকটা মজবুত তারা বাল্টিক এবং নর্ডিক দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের সভাপতি এবং প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল থাকতে পারেন এই সম্মেলনে।
অন্যান্য দেশগুলো পরবর্তী বৈঠকে থাকবে বলে জানা গেছে। প্যারিসের এই সমাবেশ আকারে ছোট। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে সকলের একমত হওয়াটা অসম্ভব না হলেও কঠিন হবে। পোল্যান্ড ২০২৫ সালে তার জিডিপির ৪.৪৭ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে। যুক্তরাজ্য এই দিক থেকে চেষ্টা করেও জিডিপির ২.৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রাতেও পৌঁছাতে পারেনি এখনও।
তবে নেতারা নিজেদের মধ্যে আরও ভালভাবে সমন্বয় করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন, ন্যাটোর অভ্যন্তরে ব্যয়ের পরিমাণ বাড়াতে পারেন এবং যুদ্ধ বিরতির পর ইউক্রেন পুনর্গঠনের বেশিরভাগ দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে পারেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টা আরও জোরদার করবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্যারিসে আয়োজিত সোমবারের সম্মেলন একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোকপাত করবে এবং সেটা হলো যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেনে সেনা পাঠাবে কি না।
তবে, এক্ষেত্রে যে প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে সেটা কিন্তু এই বাহিনী শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী হবে না বরং ‘আশ্বস্তকরণ বাহিনী’ বিষয়ে যারা সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি রেখার ভেতরে অবস্থান নিয়ে থাকবে।
ইউরোপীয় সৈন্য উপস্থিতির তিনটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রয়েছে। তার মধ্যে একটা হলো ইউক্রেনবাসীদের কাছে এই বার্তা পাঠানো, যে তারা একা নয়।
আর একটা বার্তা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে। ইউরোপ যে তার নিজের মহাদেশের প্রতিরক্ষার জন্য তার যা যা করনীয় তা করছে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরতে চায় তারা।
সর্বশেষ বার্তা মস্কোর প্রতি। ইউরোপ তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলতে চায় যে, রাশিয়া যদি চূড়ান্ত যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের মোকাবিলা শুধুমাত্র কিয়েভের সঙ্গে হবে না।
তবে এই পুরো বিষয়কে ঘিরে বিতর্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়, ভোটারদের কাছে এটা (বিষয়টা) জনপ্রিয় নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ইতালিতে ৫০ শতাংশ মানুষ ইউক্রেনে আর অস্ত্র পাঠাতে চান না। সুতরাং সেখানে তাদের সন্তান, কন্যা, বোন বা ভাইদের পাঠানো সহজে তারা মেনে নেবে না।
এদিকে, এমন বহু প্রশ্ন রয়েছে যার এখনও কোনও উত্তর মেলেনি। যেমন ইউরোপের প্রতিটা দেশকে কত সংখ্যক সৈন্য পাঠাতে হবে, কত সময়ের জন্য পাঠাতে হবে এবং তারা কার কমান্ডের অধীনে থাকবে? তাদের মিশনের বিবৃতি কী হবে?
উদাহরণস্বরূপ, যদি রাশিয়া তাদের সম্মত হওয়া যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে তাহলে ইউরোপীয় সৈন্যরা সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দেবে? যদি তাই হয় তাহলে সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের পাশে থাকবে? এমন একগুচ্ছ প্রশ্ন রয়েছে।
এখন এটা একটা বিষয় যে, ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন করার আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিশ্চয়তা’’চায় ইউরোপ। তবে তারা সেটা না-ও পেতে পারে।
প্যারিসে আয়োজিত এই সম্মেলনে এত কিছু বিষয় সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা মেলাটা কঠিন। এদিকে এটাও উল্লেখযোগ্য যে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য নেতারা তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ উদ্বেগকে সঙ্গে নিয়ে প্যারিসের এই সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন।
তবে এখন পর্যন্ত বলা যেতে পারে পুরো বিষয়টা সম্পর্কে কোনও পোক্ত ধারণা পাওয়ার বদলে একটা সামগ্রিক ধারণা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি এই সম্মেলনে। তবে এটা ঠিক যে এর মাধ্যমে প্রকাশ্যে আলাপ-আলোচনা অন্তত শুরু হতে পারে।
প্রশ্ন এটাও যে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বিষয়ে মনোযোগ দেবেন কি না? উত্তর হলো, এটা বলা মুশকিল। প্যারিসের এই সম্মেলনের পর ওয়াশিংটনে দূত পাঠিয়ে ইউরোপ নিজেদের কথা তুলে ধরতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ।
এদিকে কিয়ের স্টারমারের কয়েক দিনের মধ্যে ওয়াশিংটন সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সেতুবন্ধন করার জন্য প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করার জন্য এটা তার কাছে একটা সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।
ব্রেক্সিটের পর যে তিক্ততা দেখা গিয়েছিল সেটা ভুলে যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে আরও একবার সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিতে পারে প্যারিসের এই সমাবেশ।
এদিকে বাণিজ্য সম্পর্ক এবং আইন প্রয়োগকারী সহযোগিতার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আরও মজবুত সম্পর্ক আশা করছে যুক্তরাজ্য।
যদি যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার দিক থেকে ইউক্রেন এবং ইউরোপের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে তবে তাদের নিজেদের প্রতিরক্ষার বিষয়টা এমনিতেও মজবুত করতে হবে। বলা যেতে পারে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ব্যাপারে লক্ষ্য না রাখলেও ভ্লাদিমির পুতিনের নজর কিন্তু এদিকেই থাকবে।