সারাবাংলা
ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে

নাটোরের বাগাতিপাড়ায় প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে উঠা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে। আধুনিকতার প্রভাবে হুমকির মুখে গিয়ে পড়েছে এই শিল্প। আগের চেয়ে অনেকাংশে কমে গেছে কুমারপাড়ার ব্যস্ততা। মাটির তৈজসপত্রের চাহিদা কমে যাওয়া, অভাবে অনটনে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে।
হাট-বাজারেও এখন আর আগের মতো মাটির তৈজসপত্রের পসরা বসে না। তবে এখনো কিছু কুমার পরিবার ধরে রেখেছেন বাপ-দাদার ওই পেশা। উপজেলার পাঁকা ও জামনগর দুই ইউনিয়নের পালপাড়া নামক দুইটি গ্রাম আছে। দুই গ্রাম মিলে প্রায় ১৪ টি পরিবার এই দুর্দিনের মধ্যেও তৈরি করে যাচ্ছেন নানা ধরনের তৈজসপত্র। ধরে রেখেছেন বাপ দাদার শেপা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দুই ইউনিয়নের মৃৎশিল্পীরা শুধু নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে শুকনা খড়, লাকড়ি, মাটি, বালি ও পানির সাহায্যে তৈরি করছেন, মাটির ব্যাংক, দধির পাত্র, পিঠাখোলা, ফুলের টব, ভাতের পাতিল, পাতিলের চাকনা, তরকারি কড়াই, রসের হাঁড়ি, কুপ জ্বালানি পাত্র, মুড়ির পাতিল, প্রদীপ জ্বালানি পাত্র, জলকান্দা, গ্লাস, জগ, মগ, থালা, বাসন, মশার কয়েল স্টান্ড, শিশুদের জন্য নানা রকমের খেলনাসহ আরও বিভিন্ন ধরনের প্রায় ১০০টির বেশি মাটির তৈজসপত্র। আর এসব বিক্রি করা হয় খুবই অল্প মূল্যে। এছাড়া তৈরি করা হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন প্রতিমা।
উপজেলার জামনগর ইউনিয়নে পালপাড়ার মৃৎশিল্পী শ্রী সুসিল চন্দ্রপাল (৪২) ও নিতাই চন্দ্রপাল (৫০) জানান, তাদের বাপ দাদাদের সময় ১২০ টি পরিবার এ পেশায় জড়িত ছিল তার পরে কমে এটা ১৯ টি পরিবারে নেমে আসে। আর এখন মাত্র ৭টি পরিবার এ পেশায় নিয়োজিত আছেন। তারা আক্ষেপ করেন বলেন তারা চলে গেলে আর হয়ত এ পেশায় কাওকে পাওয়া যাবে না। তারা নিজেরা এ পেশায় জড়িত থাকলেও ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করে অন্য পেশায় কর্মসংস্থান করছেন। সারাদিন হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জিনিস পত্র তৈরি করেন আর তা বিক্রি করেই তাদের সংসার চলে। জিনিসপত্রের উচ্চ মূল্য,তারপরও আধুনিক প্লাস্টিকের বিভিন্ন রকম সামগ্রী বাজারে পাওয়ায় এখন আর আগের মতো মাটির তৈজসপত্রের চাহিদা নেই। এ পেশায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই ধরনের পেশায় সম্পৃক্ত থাকায় অবহেলিত হিসেবে কেও কখনো খোঁজ রাখেনি। এমনকি পাইনি কোনো সরকারি অনুদান।পুজোর সময় বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে প্রতিমা তৈরি করলে কিছু টাকার মুখ দেখতে পাওয়া যায়।
উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের পাঁকা পালপাড়ার মৃৎশিল্পী লক্ষীকান্ত পাল (৪৮) জানান, তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ৪ সদস্যের তার পরিবার। তার এলাকায় তার মত আরও সাতটি পরিবার এ পেশায় নিয়োজিত আছে। খুব কষ্টে দিন যাপন করছেন তারা। রাতদিন হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। যা রোজগার হয় তা সংসারের পিছনেই শেষ হয়ে যায়। সরকারি কোনো সাহায্য সহোযোগিতা তারা কখনোও পাননি। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এলাকার এনজিও হতে ঋণ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তিনি মাটি দিয়ে প্রায় ১০০ শত রকমের বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করেন। সে গুলো রাজশাহী শহরে বিনোদপুর এলাকায় প্রাইকারি বিক্রি করে থাকেন। কারণ আগের মত আর মানুষ বাড়িতে কিনতে আসে না। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের ব্যবহৃত কাঁচামাল যেমন বিশেষ ধরনের মাটি, জ্বালানি খরচ, রং করাসহ এই সব খেলনাসামগ্রী বিক্রি করে আর আগের মতো পোষাচ্ছে না। বাপ-দাদার ব্যবসাকে ধরে রাখার জন্য শুধু এগুলো তৈরি এবং বিক্রি করছেন। এগুলো তৈরি করতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, ওই একই দামে বিক্রি হয়। সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পেলে হয়তো আস্তে আস্তে এক পর্যায়ে এই ধরনের মৃৎশিল্প এই এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এ নিয়ে জামনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানীর জানান, মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সহজ শর্তে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ঋণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সুযোগ ও প্রক্রিয়ায় বিভিন্নমুখী উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন। আর তার ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তিনি যতটুকু পারেন তাদের সাহায্য করে থাকেন এবং ভবিষ্যতে করবেন বলে জানান। একই কথা বলছেন, পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. হেলাল উদ্দিন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হা-মীম তাবাসসুম প্রভা বলেন, মৃৎশিল্পদের আর্থিকভাবে সাহায্য করার মত আলাদ কোনো প্রকল্প বা ফান্ড নেই। তবে অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা থাকলে স্ব-ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে আবেদন করলে তখন তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবো।