সারাবাংলা
ঠাকুরগাঁওয়ে উপহারের ১১০টি ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন বাসিন্দারা
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের কান্দরপাড়া টাঙ্গন নদীর পাশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৫১টির মধ্যে ১১০টি ঘরে তালা দিয়ে পালিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। এরপর থেকে এসব ঘরে ফাঁকা পড়ে আছে। ওই ঘরগুলো এখন বহিরাগতদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় এসব ঘর নির্মাণ করা হয়। নাম দেওয়া হয় সোনালী স্বপ্নময় আশ্রয়ণ প্রকল্প। ওই সময় প্রতিটি ঘর তৈরিতে ব্যয় ধরা হয় ২ লাখ টাকা। নির্মাণের কয়েক মাসের মধ্যে ২ শতক জমিসহ ঘরগুলো বাসিন্দাদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
এরইমধ্যে প্রকল্পের বেশ কিছু ঘরে ফাটল ধরেছে। ভূমিকম্প বা ঝড়ে ভেঙে পড়ার ভয়ে অনেকেই ঘরে ছেড়ে চলে গেছেন। প্রকৃত ভূমিহীন বাছাই করতে না পারা স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক অনিয়ম করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এছাড়া প্রকল্পের অধিকাংশ ঘর এক নামে বরাদ্দ নিলেও থাকছেন অন্যরা। তাদের অভিযোগ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ও কাজের অভাবে অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের দেওয়া আশ্রয়ণের ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এছাড়া নদী পারাপারের জন্য থাকা বাঁশের সাঁকোটিও ইতোমধ্যে ভেঙে গেছে।
আশ্রয়ণের প্রতিটি ঘরে রয়েছে দুটি কক্ষ, একটি রান্নাঘর ও একটি শৌচাগার। রয়েছে বিদ্যুৎ আর সুপেয় পানির ব্যবস্থাও। কিন্তু সেখানের অধিকাংশ ঘরই ফাঁকা পড়ে আছে। যারা থাকছেন, তাদের বেশির ভাগেরই নিজের নামে ঘর বরাদ্দ নেই। যাদের নামে বরাদ্দ ছিল তারা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখে পালিয়ে গেছে। তাদের রেখে যাওয়া ঘরগুলোতে অন্য বাসিন্দারা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে বসবাস শুরু করলে এখন তারা এসে তাড়িয়ে দিচ্ছেন।
সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সকালে ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ ঘরে ঝুলছে তালা। ঝাড় জঙ্গলে ভরে গেছে ঘরগুলো। বারান্দা ও আশেপাশে জমে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। কয়েকটি ঘরের জানালা-দরজা নেই। কোনো কোনো ঘরের উঠানে চলছে সবজি চাষ। বাসিন্দাদের পানি খাওয়ার জন্য টিবওয়েল বসানো হলেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা আলম নামে এক ব্যক্তি তা খুলে নিয়ে গেছেন।
আলম ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ম্যানেজার পরিচয়ে অর্থের বিনিয়মে সকাল-বিকেল ঘর পরিবর্তন করে দিচ্ছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে দেওয়া হয় হুমকি-ধামকি।
তবে উপজেলা প্রশাসন বলছেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের দেখভালের জন্য আলম নামে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি আশ্রয়ণ প্রকল্পের পুকুরের মাছ তুলে নিয়ে খাচ্ছেন স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয়রা জানান, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর প্রকৃত ভূমিহীন-ঘরহীন ব্যক্তিরা বরাদ্দ পাননি। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করেই যাদের নিজস্ব বাড়ি ও জমি-জমা রয়েছে, তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেয়ে তারা ঘরে থাকছেন না।
ওই আশ্রয়ণের বাসিন্দা রহমত আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানের বেশিরভাগ ঘরেই লোকজন থাকেন না। ফাঁকা পড়ে আছে। আমাদের জমি নাই, ঘর নাই, তাই এখানে থাকি। কিন্তু আমাদের নামে কোনো কাগজ নাই। যারা আগে ছিল তারা ৫-৬ হাজার টাকা করে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখে গেছে। তা আমরা এখন পরিশোধ করছি। এখন তারা এসে বলছে প্রতিমাসে ভাড়া দিতে হবে।
জরিনা বেগম নামে এক বৃদ্ধা বলেন, যাদের নামে এই ঘর, তারা তো থাকেন না। ঘরের মালিক মাঝেমধ্যে এসে খোঁজখবর নিয়ে যান। তারা আমাকে বাইরে করে দিলে আমি কোথায় থাকব। একটা টিবওয়েলে আমরা ৮টি পরিবার ব্যবহার করছি। তাঁর মধ্যে আদিবাসী আছে আমাদের জন্য খুবই অসুবিধা হয়ে গেছে একটি টিবওয়েল।
জসিম বলেন, এখানে থাকার মতো কোনো অবস্থা নেই। ঘরের জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। বাইরের ছেলেরা এখানে এসে নারী নিয়ে আড্ডা জমায়। এখানে যাদের নামে ঘর দিয়েছে, তারা তো বড়লোক, তারা এখানে থাকেন না। আমরা এখানে আছি কিন্তু আমাদের নামে কোনো কাগজ হচ্ছে না।
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মমেন সিং বলেন, কান্দরপাড়া আশ্রয়ণটি প্রত্যন্ত এলাকায়। দুই দিক দিয়ে টাঙ্গন নদী বয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। তা ছাড়া সেখানে দূরের বাসিন্দাদের ঘর দেওয়া হয়েছে। সেসব ঘরে বাসিন্দারা থাকছেন না।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খায়রুল ইসলাম জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে কিছু লোক থাকেন না বলে শুনেছি। তাদের ঘরগুলো চিহ্নিত করে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের লোকজনকে তুলে দেওয়া হবে। আর আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের যেসব সমস্যা রয়েছে তা সমাধান করে দেওয়া হবে। যারা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করেই চলে গেছে এবং যিনি অর্থ লেনদেন করছেন তাওর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।