জাতীয়

প্রসঙ্গ: জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা

নুরুল্লাহ মাসুম

ইদানিং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন নিয়ে একটি গোষ্ঠী অস্থির হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে কেবল আম-জনতাই নয়, আছে কিছু জ্ঞানপাপীও। কোথায় ছিলো তারা ৫৩টি বছর? ৫৩ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল ৩+৫+১৬=২৪ বছর। বাকী ২৯ বছর কারা ক্ষমতায় ছিলো? জাতীয় পর্টি, বিএনপি ও জামাত, তাই নয় কি? তখন এরা কই ছিলো? তখন কেন জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে কোন কথা হয়নি?

জ্ঞানপাপীরা বলছে, রবীন্দ্রনাথ এদেশর মানুষ নন। তারা কি জানে যে, রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষ খুলনার বাসিন্দা? রবীন্দ্রনাথের মামা বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়িও খুলনায়? অন্যদিকে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের চৌদ্দপুরুষ বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার বাসিন্দা, মানে তারা বাঙালি নয়, ঘটি (জাতীয় কবিকে অসম্মান করে বলছি না); ঘটিরা আমাদের বলে বাঙাল, একথা কি তারা জানে? কাজী নজরুলকে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকায় এনে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। কাজী নজরুলের লেখা গান যেমন স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছে, তেমনি প্রেরণা যুগিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানও।

রবীন্দ্রনাথ হিন্দু বলেই আজ একটি বিশেষ গোষ্ঠী তাঁর লেখা গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মানতে চাইছে না; বদলাবার কথা বলছে মুর্খের মতো। কেউ বা বলছে জাতীয় সঙ্গীতে “বাংলাদেশ” নামটা নেই। ওরে গাধার দল, দেশটা বরাবরই “বাংলা” ছিলো। স্বাধীনতার পরে ভারতের “পশ্চিম বঙ্গ”-এর সাথে পার্থক্য করার জন্যই স্বাধীন দেশের নামকরণ হয়েছে বাংলা+দেশ= বাংলাদেশ। ওরা ভুলে যায় কেন, মুসলিম শাসনামলের “বাংলা সালতানাত”, মোঘল আমলের “সুবেহ বাংলা”, বৃটিশ আমলের “বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি”- সবই এক বাংলা।

“আমার সোনার বাংলা” লেখা হয়েছে ১৯০৫ সালে। সঠিক তথ্য। কেন লেখা হয়েছিলো, তা কি জানা আছে? বৃটিশরা যখন তাদের শাসন-শোষনের সুবিধার্থে বাংলা ও পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করছিলো, তখন রবীন্দ্রনাথ বাংলা মায়ের অখণ্ডতা বজার জন্য এই গান লিখেছিলেন। যদিও শেষ রক্ষ হয়নি। বৃটিশরা বিদায় নেবার সময় হিন্দু-মুসলিম বিভেদ করে বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করে দুই দেশের অন্তর্ভুক্ত যায়। আর আমাদের জ্ঞানপাপীরা বৃটিশদের দেয়া টোপ গিলে আজো ঢেকুর তুলছে! হায়রে বাঙালি! ওরা আরো বলছে আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশী। স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয়তা ছিলো “বাঙালী”। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বাঙালীকে বাংলাদেশী বানিয়েছিলো; একথা ভুলে যাই কি করে! তোমরা যারা মধ্যপ্রাচ্যের অর্থে লালিত এবং তাদের আদর্শ নিয়ে চলো, তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, ওখানে গিয়ে দেখো, ওরা আজো আমাদের “বাঙালী” বলেই জানে ও সম্বোধন করে।

একদল বলছে, গগন হরকরার “আমি কোথায় পাবো তারে” গানটি চুরি করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “আমার সোনার বাংলা” গানটি। তাদের জানা উচিত রবীন্দ্রনাথ তারই প্রজা, সাধারণ এক হরকরার কণ্ঠে দেশপ্রেমের এমন একটি গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে তাকে অবহিত করেই ওই গানের সুরটিকে অনুসরণ করে লিখেছিলেন আরেকটি দেশপ্রেমের গান “আমার সোনার বাংলা”। তিনি তো গগন হরকরাকে অস্বীকার করেননি! আজ যে সকল জ্ঞানপাপী গগন হরকরার কৃতিত্ব তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার প্রয়াস পাচ্ছে, তারা এতকাল কোথায় ছিলো (বিশেষ করে বিগত ৫৩ বছর)?

আরেক গর্ধব বলছে, জাতীয় সঙ্গীতের “কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো- কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে” চরণটি নাকি গাঁজা না খেয়ে রাখে যায় না। তার কথার মানে হচ্ছে, যারা গাঁজা খায়, তারাই বটের মূলে আঁচল বিছাতে পারে! পুরো গানটা শুনে দেখেছিস হে গর্ধব? গানের প্রতিটি কলিতে বাংলার আবহ রয়েছে। বটবৃক্ষ বা বড় বড় গাছের নিচেই আঁচল পেতে ভরদুপুরে বিশ্রাম নেয় চাষী, যারা তোদের অন্ন যোগায়। ওরা জানবেই বা কি করে? পল্লী বাংলা রূপ-রস-গন্ধ ওরা কোনকালে দেখেছ বা পেয়েছে বলে মনে হয় না। এক বা দু্ই জেনারেশন শহরে বা নগরে বাস করে পল্লী বাংলাকে ভুলে গেছিস রে হতভাগার দল! যেই পল্লী বাংলার ফসল খেয়ে, পল্লী বাংলার বায়ু-জলে গতরখানি বড় করেছিস; সেই বাংলা মাকে ভুলে যাচ্ছিস! “ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে, ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি”- ফাগুন মাসে আমের বনে গেছিস কখনো? বুঝবি কি করে? আর অগ্রহায়ন মাসে পাকা ধানের সুমিষ্ট গন্ধ পেয়েছিস কখনো? খাচ্ছিস তো মিনিকেট নামের নকল(!) চাল, আউশ-আমন ধানের স্বাদ পাবি কোথায়?

আরেক শিক্ষিত জ্ঞানপাপী বলছে, গানে ‘মা’ বলতে কালী বা দুর্গা দেবীকে বুঝানো হয়েছে। জ্ঞানের বলিহারি রে বাবা! জন্মভূমিকে বলা হয় জননী। গানে ‘মা’ বলতে ‘বাংলা মাকেই’ বুঝানো হয়েছে। একথা ওই গর্ধবও জানে, তবে অসৎ উদ্দেশ্যে না জানার ভান করছে। জননী যেমন তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে এবং প্রতিপালন করে। বাংলা মাও তার সন্তানদের (বাঙালিদের) ধারণ করে (বসবাসের সুযোগ দেয়), প্রতিপালন করে বায়ু-জল-খাদ্য-আলো-ছায়া দিয়ে। এখানে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের কোন দেব-দেবীকে বুঝিনো হয়নি। যারা জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের কথা বলে, তারা অবশ্য মাকে মা ডাকে না, ডাকে মাম্মি। তাই তারা মায়ে মর্ম বা অর্থ বোঝে না। এটাই মনে শান্তি এনে দেয়।

লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা পরিবর্থনের কথাও বলছে একটি গোষ্ঠী। তারা কি জানে সবুজের মাঝে লাল সূর্যের মর্ম কী? কেউবা পতাকায় আল্লাহর নাম খোদাই করার কথা বলছে। বাংলাদেশটা কি কেবল মুসলমানদের? অন্য ধর্মের লোকেরা যদি তাদের ধর্মের বাণী বা তাদের স্রষ্টার নাম খোদাইয়ের দাবী করে, তাহলে কী বলবে তারা! সকলকে মনে রাখতে হবে- বাংলা ভূমি, যা আজ বাংলাদেশ নামে বিশ্বি পরিচিত; আরব, পারস্য, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক বা বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে এসে এখানে আবাস গড়ে তোলে, তারা এক দুই যুগ নয়, হাজার বছর ধরে এখানেই বসবাস করছে। বাংলা মায়ের আঁচলেই লালিত-পালিত হয়েছে। তাদের বংশধরেরা সকলেই এখন বাঙালি। যার মায়ে ভাষা বাংলা, এসই বাঙালি। রাজনৈতিক কারণে এখন জাতীয়তা বাংলাদেশী হলেও আমাদের বাঙালিত্ব খর্ব হয়ে যায়নি। বাংলাদেশে আমরা বাংলাদেশী বাঙালি। ভারতেও বাঙালি রয়েছে, তারা ভারতীয় বাঙালি। বিশ্বে যে দেশেই বাস করিক না কেন, যার মাতৃভাষা বাংলা, সেই বাঙালি। এখানে বিভেদ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়।

“আমার সোনার বাংলা” আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ছিলো, তাই থাকবে। “লাল-সবুজের জাতীয় পতাকাও বহল থাকবে। যারা এদুটো মানতে পারবে না, তাদের বলবো- তোরা সংখ্যালঘু, বাংলাদেশ তোদের জায়গা নয়, নতুন জায়গা খুজে নিতে পারিস।

ট্যাগসমূহ
আরও দেখুন

এ বিষয়ের আরও সংবাদ

Close