স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবনের আয়োজনে প্রথম শহীদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসার জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা ও দোয়া মুনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠযোদ্ধা ও স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবনের প্রধান উপদেষ্টা মনোরঞ্জন ঘোষাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্পোর্টস ল’ এন্ড ল’ইয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক মোঃ শাখাওয়াত হোসেন, অ্যাডভোকেট কমিশনার মুহাম্মদ আবদুল আউয়াল সুমন, স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবনের পরিচালক নোমান বিন সাদেক ও মোহাম্মদ সোহেল প্রমুখ। স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবনের পরিচালক ফরিদ আহমাদের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবনের পরিচালক রিয়াজ মাহমুদ মিঠু।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অডিও বার্তায় মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কবি মেহেরুন্নেসার অবদান অনস্বীকার্য। তার লেখা গান কবিতা মানুষের মাঝে ভীষণভাবে আকর্ষিত করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার জন্ম ও মৃত্যুদিন পালন না করা খুবই দুঃখজনক। স্বপ্নকলাকে ধন্যবাদ তারা মেহেরুন্নেসাকে নিয়ে ভাবছে এবং আয়োজন করছে।
আমি আরও আগে থেকে দাবি জানিয়ে আসছি এবং এখনো দাবি জানাচ্ছি যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে তার উপর গবেষণা এবং জন্ম ও মৃত্যুদিন পালন করার। সভাপতির অতিথির রিয়াজ মাহমুদ মিঠু বলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বিলীনপ্রায় মেহেরুন্নেসার অবদান আত্মত্যাগ ও কর্মকান্ড। দায়িত্ব বোধের কর্তব্য থেকেই স্বপ্নকলা সাংস্কৃতিক ভুবন এ কাজটি করছে এবং করবে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে চেতনা ধারণ করতে হলে কবি সাহিত্যিকদের জীবনাচার নিয়ে গবেষণা ও তাদের চিন্তা চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে। আবদুল আউয়াল বলেন, আজ মেহেরুন্নেসাকে নিয়ে একটি সংগঠন একটি জায়গায় জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা করছে। তার যে কর্ম তা নিয়ে প্রতিটি জেলা পাড়া মহল্লায় আলোচনা করার দাবি রাখে।
উল্লেখ্য, ২০ আগস্ট ১৯৪২ সালে কলকাতার খিদিরপুরে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম শহীদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসা। পিতা-আবদুর রাজ্জাক, মাতা নূরুন নেসার চার সন্তানের মধ্যে মেহেরুন নেসা (রানু) ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৪৭ সালে বিভক্ত ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর তাঁর পুরো পরিবার চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (ঢাকায়)। ‘কাফেলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত মেহেরুন নেসার ‘রাজবন্দী’ কবিতার দুটি পংক্তি ছিল আমাদের দাবী মানতে হবে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। এই কবিতা ছাপা হওয়ার পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে আসলেও ছোট মেহেরকে দেখে চলে যান এবং বাবাকে বলে যান ওকে লেখা বন্ধ করার জন্য। এরপরে মেহের অনেকদিন সকল প্রকার লেখা বন্ধ রাখে। মেহেরুন নেসা রানু আপা নামে ‘পাকিস্থানী খবর’-এর মহিলা মহল পাতার সম্পাদনা করতেন। কবি হিসাবে তিনি ছিলেন সত্যিকার কবিতাকর্মী। খুব আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতার সাথে তিনি জনতার সাড়িতে এসে দাঁড়ান। তার কবি প্রতিভাই আদায় করে নিয়েছিল কবি সুফিয়া কামালের স্নেহ অনুকূল্য। কবি আবদুস সাত্তার ছিলেন তার অন্যতম বন্ধু। ‘বেগম’ পত্রিকায় তাঁর শেষ কবিতা ‘জনতা জেগেছে’ প্রকাশিত হয় ২৩ মার্চ (তার মৃত্যুর মাত্র তিন দিন পূর্বে) ১৯৭১ সালে। গণতন্ত্রের দীপ্ত শপথ কণ্ঠে কণ্ঠে সাধা / আমরা ভেঙ্গেছি জয় বাংলার যত বিজয়ের বাধা।
একাত্তরে বিহারি অধ্যুষিত মিরপুরে কাজী রোজির নেতৃত্বে অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা। তিনি অবাঙ্গালীদের হুশিয়ারি উপেক্ষা করে সর্বদলিয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকা কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন। এই অপরাধে ২৭ মার্চ তাঁর মা, দুই ভাই ও তাঁকে নির্মম-নিষ্ঠুর বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করা হয়। আর তিনি হন বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মহিলা কবি। ১৯৫২ সালে মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন তার খুরধার লেখনির মাধ্যমে এবং জায়গা করে নেন সংগ্রাম, ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, অনন্যা, কাফেলা, বেগম, যুগের দাবীসহ তৎকালিন প্রায় সকল পত্রিকায়।