জনাব ওয়াহিদ সিদ্দিকী। বন্ধুবৎসল ও আপাদমস্তক ভদ্র মানুষ হিসেবেই তাঁকে জেনেছি। তবে দীর্ঘ দেড়-বছরের সে পরিচয় ছাপিয়ে তিনি এখন আমার কাছে একজন সুনিপুন পর্যবেক্ষক। বাবার কর্ম সুবাদে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খল জীবন দেখেই বেড়ে ওঠা এক সময়ের সেই তরুণ আজ পঞ্চাশোর্ধ অভিজ্ঞতায় টৈটম্বুর!
‘সমুজ্জ্বল অতীত’ তাঁর লেখা স্মৃতি-সংকলন। তবে তাঁকে আমি প্রাবন্ধিক বলাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব। তাঁর সংকলনে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন শিক্ষনীয় বিষয়াদি। যা তিনি কোন বই থেকে শেখেননি। বরং জীবন থেকে শিখেছেন, সময় থেকে শিখেছেন।
তাঁর লেখা থেকে প্রথমবারের মত জেনেছি, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা লাভের পর, সাধারণ বাংলাদেশীরা কিভাবে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। যা নি:সন্ধেহে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার জানার পরিসীমাকে বিস্তৃত করেছে।
যেহেতু এই প্রকাশনাটি প্রাবন্ধিকের স্মৃতি-সংকলন তাই তাঁর লেখনীর বেশীরভাগ জুড়েই ছিল কর্মকালীন স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা। পেশাগত কাজে সমৃদ্ধি লাভে তাঁর ছোট-খাটো ট্রিকস তিনি বেশ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি যেমন সুনশান দুপুরে বানরদের সাথে খাবার ভাগাভাগি করেছেন তেমনি সমাজের প্রান্তিক শ্রেণী- ডোম এর সাথেও গড়ে তুলেছেন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তিনি সম্পর্ককে অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। অর্থাৎ শুধু পেশাগত কাজের জন্য সম্পর্ক তৈরী করেননি বরং তা পেশার দরূণ সূচনা হলেও চলেছে জীবনের জন্য, মানবতার জন্য। তাইতো তিনি কয়েক দশক পরেও পঙ্গুত্ব বরণকারী ডোমকে দেখতে গিয়েছেন গাজীপুরে; স্মরণ করেছেন ফাইসন্সের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা প্রয়াত আরেফিন সাহেবকে।
প্রাবন্ধিক সিদ্দিকীর লেখনী শৈলীতে মানবপ্রেমের পাশাপাশি উঠে এসেছে প্রকৃতির প্রতি এক অসম্ভব রকমের ভালবাসার কথা। তিনি কালো কালির অক্ষরে ছবির মত তুলে ধরেছেন মাধবকুন্ডুর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা তাঁর শৈশবের কথা। এমনকি পাকিস্তান পাঠান উইলসান আহমাদ এদেশে ভ্রমনকালে তিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও হয়েছেন তাঁর সফর সঙ্গী; করেছেন মাঝ রাতের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। আর ক্রেডিট কার্ড নিয়ে তাঁর উল্লেখ করা মন্তব্য আমার জন্য এক অন্যতম শিক্ষা- ‘মায়ের দুধের ঋণ শোধ হলেও; ক্রেডিট কার্ডের ঋণ শোধ হয়না!’
জনাব সিদ্দিকী এই সংকলনে ২৭টি প্রবন্ধ একত্র করেছেন। প্রতিটি প্রবন্ধ এতো সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন যে, তা পাঠে কোন ক্লান্তিবোধ হয়নি এবং নাতিদীর্ঘ সেই ঘটনাগুলো এতো দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল যেন- ‘আর এট্টু হলে ভালো হতো’ এমন তৃষ্ঞায় সমাপ্ত হয়েছে। হাতেগোনা দু/চারটি প্রবন্ধ ছাড়া সকল প্রবন্ধই ছিল বেশ উচ্চমানের এবং তথ্য সমৃদ্ধ। তবে তথ্যের সাথে মানবিক ভাবনা মিশে প্রবন্ধগুলোর শিল্পমান এক ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে।
জনাব ওয়াহিদ সিদ্দিকী তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে দেশের একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত হোন; এই আমার প্রত্যাশা।