ভ্রমণ

পেয়ারা বাগান দর্শন, জ্যান্ত ইলিশ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ- দ্বিতীয় পর্ব

নুরুল্লাহ মাসুম

ঢাকা থেকে লঞ্চ যাত্রায় গ্রুপের বেশীরভাগ সদস্যের নির্ঘুম রাত কাটানো এবং প্রথম দিনের টাইট সিডিউলের কারণে এবং অবশ্যই গত রাতের ভুড়িভোজের কারণে দ্বিতীয় দিনে সকলের বিছানা ছাড়তে খানিকটা বিলম্ব হয়, শুধু তাই নয় সকালের নাস্তাও একসাথে খাওয়া হয়নি। ফলে কর্মসূচির আরম্ভ করতে বেশ কানিকটা বিলম্ব হয়। বেলা সাড়ে দশটার দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়: গন্তব্য দূর্গাসাগর দীঘি।


বরিশাল শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে স্বরূপকাঠি-বরিশাল সড়কে মাধবপাশায় এ দীঘি। দীঘির আকার ২৭ একর। পাড় ও জমিসহ মোট আয়তন ৪৫.৪২ একর। ১৭৮০ সালে চন্দ্রদ্বীপের (বরিশাল অঞ্চলের প্রাচীন নাম) পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ন এই বিশাল জলাধারটি খনন করেন। তার স্ত্রী দুর্গামতির নামানুসারে এর নামকরণ হয় দুর্গাসাগর। ১৯৭৪ সালে সরকারের উদ্যোগে দিঘীটির সংস্কার করা হয়। বর্তমানে “দুর্গাসাগর দিঘীর উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য” নামে একটি প্রকল্পের অধিনে বরিশাল জেলা প্রশাসন দিঘীটির তত্ত্বাবধান করছে। সম্পূর্ণ দীঘিটি উঁচু সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেড়া। এর দু’দিকে ‍প্রবেশের জন্য দুইটি গেট রয়েছে, যদিও একটি বন্ধ রাখা হয়েছে। দীঘির মাঝখানে জঙ্গলপূর্ণ একটি ছোট দ্বীপ আছে। শীতকালে এখানে অতিথি পাখির সমাগম হয়। চৈত্রমাসের অষ্টমী তিথীতে হিন্দু ধর্মালম্বীরা এখানে পবিত্র স্নানের উদ্দেশ্যে সমবেত হন।


দুটো ব্যাটারী চালিত অটো রিক্সা, যা এখানে অটোবাইক নামে পরিচিত, ছিল আমাদের বাহন। আজ আমাদের গ্রুপে কেবল হুমায়ূন রয়েছে, তাই সংখ্যাটা বেজোড়-১১ জন। দূর্গাসাগর দীঘিতে পৌছে আমরা প্রচন্ড তাপদাহের মাঝেও পেয়ে যাই ছায়া-শীতল পরিবেশ। বেশ খানিকটা সময় কাটে আমাদের এখানে। দীঘির চারিধারে ভ্রমণ সম্ভব হয় না সময়ের অভাবে এবং গরমের কারণে। দীঘির এলাকার মধ্যে রয়েছে মাধবপাশা স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র, যেখানে প্রবেশ করতে হয় দীঘির মূল গেট দিয়ে। ফলে স্থানীয়দের মাঝে রয়েছে একটা চাপা ক্ষোভ। কারণ দীঘি এলাকায় প্রবেশের জন্য মূল্য পরিশোধকরতে হয়; স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য যা প্রযোজ্য নয়। ফলে প্রায়শই সমস্যা দেখা দেয়, কে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাচ্ছে, কে বা দীঘি দেখার জন্য পর্যটক হয়ে এসেছে। কর্তৃপক্ষের একটু বোধোদয় হওয়া প্রয়োজন বিষয়টি নিয়ে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পেছন দিক থেকে পৃথক প্রবেশ পথ এখনো তৈরি করা সম্ভব, তাহলে স্কুলের মাঠের মধ্য দিয়ে সরাসরি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়া সম্ভব হবে। স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে অনতিদূরে পিকনিক স্পট করা হয়েছে, আছে দুটো ছোট ছোট মঞ্চ- যে কোনো ধরণের আয়োজন করার জন্য। দেখতে পেলাম, দুটো প্যাডেল বোট তৈরি করা আছে দীঘিতে নামানোর জন্য, কবে নাগাদ নামানো হবে তার জানা গেল না।


দূর্গাসগরের গেটের বাইরে হলো হালকা নাস্তার ব্যবস্থা। গরুর দুধের চায়ের জন্য সকলেরই অপেক্ষা ভেতরে থাকতেই। মিললোও বটে, তবে তা কতখানি খাঁটি ছিল তা বলা যাচ্ছে না। এরপর অপেক্ষারত ইজিবাইকে করে যাত্রা শুরু হলো লাকুটিয়া জমিদার বাড়ির উদ্দ্যেশে।
লাকুটিয়ায় পৌছানোর জন্য মাধবপাশা থেকে একই রাস্তায় ফিরে কাশিপুর হয়ে পিচঢালা পথ পেড়িয়ে বেশ খানিকটা সুরকি বিছানো পথ ধরে এগুতে হলো। দেশের অন্যান্য প্রায় সকল পুরাকৃর্তীর মতো লাকুটিয়া জমিদার বাড়িটিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। ওখানে বসে এ বাড়ি সম্পর্কে জানার মতো কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ জানাগেল বাড়িটিকে ঘিরে রয়েছে প্রায় চার শ’ বছরের ইতিহাস।
বাড়ির প্রবেশ পথে দৃষ্টিনন্দন মঠ এবং বাড়ির পাশে রয়েছে বিশাল দীঘি ও মাঠ। কারুকার্য খচিত জমিদার বাড়ির নিচের অংশে বিশাল একটি গোপন কামড়ার আকৃতি দেখা গেলেও অযত্ন অবহেলায় তা মাটির নিচেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাড়িটি অবহেলিত থাকলেও থেমে নেই পর্যটকদের ভিড়। সরকারী উদ্যোগে জমিদার বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এটি হতে পারে বরিশালের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।


প্রায় এক একর জমি নিয়ে বাড়িটি। বাড়ির চারদিকের দেয়ালগুলোর পলেস্তারা খসে পড়তে শুরু করেছে। সহজে বাড়িটির দোতলায় ওঠার কোন উপায় নেই। বাইরের দিকের সিঁড়ি ভেঙ্গে পড়েছে অনেক আগেই। বাড়ির বেশিরভাগ স্থাপনাই আটচালা দেউল রীতিতে তৈরি। বাড়ির সামনেই রয়েছে কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন মঠ। বাড়ির পেছনের অংশের শিখররীতির কয়েকটি মন্দির ইতোমধ্যে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে বলে জানা গেল। আদিপুরুষ রূপচন্দ্র রায়ের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা পায় এই জমিদার বংশ। পরবর্তীতে ১৭০০ সালের পর এখানে রূপচন্দ্রের পৌত্র রাজচন্দ্র রায়ের জমিদারি গড়ে ওঠে। রাজা রাজচন্দ্র রায়ের এ বাড়িটি উনিশ শতকেও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পীঠস্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিল। জমিদার পরিবারের সদস্যদের খ্যাতি ছিল প্রজাকল্যাণ এবং বিবিধ জনহিতকর কার্যক্রমে। তারই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন বরিশাল শহরে নির্মিত হয়েছিল ‘রাজচন্দ্র কলেজ’। শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক ওই কলেজ থেকেই তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। বরিশাল শহর থেকে লাকুটিয়া হয়ে বাবুগঞ্জের সড়কটি নির্মাণ হয়েছিল লাকুটিয়ার জমিদারের সময়ে। পাকিস্তান আমলে ওই এলাকায় ‘পুষ্পরানী বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জমিদাররা। বংশের শেষ উত্তরাধিকারী দেবেন রায় চৌধুরী বহুকাল পূর্বেই সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। দেবেন রায় চৌধুরীর কন্যা মন্দিরা রায় চৌধুরীর বিয়ে হয় বরিশালের কাশিপুরের মুখার্জী বাড়িতে। সেখানেই তিনি (মন্দিরা) এখনও বসবাস করছেন। জমিদার বাড়ির ভগ্ন প্রাসাদের প্রবেশ মুখে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কয়েকটি মঠ। সদর দরজার দক্ষিণ পাশেই রয়েছে শান বাঁধানো ঘাটের বিখ্যাত বউরানীর দীঘি। মূল ভবনের সামনে রয়েছে একটি মাঠ, তার পরেই জমিদারের দোতলা প্রাসাদ।


কয়েক বছর আগে জমিদার বাড়িটি লিজ নিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। শুধু জমিদার বাড়ির শেষ ধ্বংসাবশেষের দ্বিতল প্রাসাদ ব্যতীত বাড়ির মধ্যেই বিএডিসির বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও বীজ সংরক্ষণাগারের একাধিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। চার শ’ বছরের পুরনো ইতিহাস আর ঐতিহ্য খ্যাত লাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি সরকারীভাবে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বরিশালে একটি পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে জোর দাবি স্থানীয়দের।
সংক্ষিপ্ত সময়ে শেষ করতে হয় লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি দর্শন। পরের গন্তব্য বরিশাল শহরে অবস্থিত মুকুন্দদাস প্রতিষ্ঠিত কালী বাড়ি, ঐতিহ্যবাহী ব্রজমোহন কলেজ, বিবির পুকুর এবং অশ্বিনী কুমার টাউন হল। ছুটে চলেছে আমাদের ইজিবাইক। নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল সন্নিহিত চারণ কবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত কালী বাড়িতে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতী।
ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বানরী গ্রামে ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দের ২২শে ফেব্রুয় বৃহস্পতিবার চারণ কবি মুকুন্দ দাস-এর জন্ম। পিতার নাম গুরুদয়ল দে, মায়ের নাম শ্যামাসুন্দরী দেবী। বাবার দেয়া নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর দে এবং ডাক নাম ছিল যজ্ঞা। জন্মের পরে ঐ গ্রাম পদ্মা নদীতে তলিয়ে গেলে তাঁরা সপরিবারে গুরুদয়লের চাকরিস্থল বরিশাল শহরে চলে আসেন। বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে তার শিক্ষা শুরু হয়। বরিশালে বৈষ্ণব সন্ন্যাসী রামানন্দ অবধূত যজ্ঞেশ্বরের গলায় হরিসংকীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দীক্ষা দিয়ে তাঁর নাম রাখেন মুকুন্দদাস। উনিশ বছরের বয়সের মধ্যে মুকুন্দ দাস সাধন-সঙ্গীত নামে একশ খানি গান সমৃদ্ধ একখানি বই রচনা করেন। তিনি বরিশাল হিতৈষী পত্রিকায় লিখতেন। যাত্রাগানে সারা বরিশাল মাতিয়ো রাখতেন।


শিলিগুড়িতে ১৯২৪ সালে মুকুন্দ দাস চারণ গানের অনুষ্ঠান করেছিলেন। সাত দিন ব্যাপী সেই অনুষ্ঠান হয়। তখন তার প্রত্যেক দিনের দক্ষিণা ছিল ৫১ টাকা। তিনি অনুষ্ঠান শেষে ৭ টাকা গুরু দক্ষিনা রেখে বাকি ৩৫০ টাকা কালী মন্দির তৈরীতে দান করে দেন (স্থানটি বর্তমানে বরিশাল নগরীতে প্রবেশমুখে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল সংলগ্ন)। ১৯২৬ সালে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়; মুকুন্দ দাস এটির নামকরণ করেন আনন্দময়ী কালী মন্দির । শুরুতে মন্দিরের জন্য মোট জায়গা ছিল ৮৭ শতাংশ, এখন আছে মাত্র ১৯ শতাংশ। বর্তমান স্থানটুকু ঘিরে আছে ছাত্রাবাস, লাইব্রেরি, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং পুজামন্দির।
বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্তের সংস্পর্শে মুকুন্দ দাস রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তাঁর আগ্রহে মুকুন্দদাস মাতৃপূজা নামে একটি নাটক রচনা করেন।

দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীতে নবগ্রামে এই নাটকের প্রথম প্রকাশ্য যাত্রাভিনয় হয়। ১৯০৫ খৃষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় মুকুন্দদাস আকের পর এক গান, কবিতা ও নাটক রচনা করে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে নূতন উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। এরপর ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করেন ও বিচারে তাঁকে দিল্লী জেলে আড়াই বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। মাতৃপূজা নাটকটি সরকার বাজেয়প্ত করে। কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথাক্রমে বাংলা মায়ের দামাল ছেলে চারণ-সম্রাট মুকুন্দ উপাধিতে ও সন্তান আখ্যায় ভূষিত করেন।
মুকুন্দ দাসের কয়েকটি বিখ্যাত গান হলো: একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, বল শ্যামা সঙ্গিনী যোগিনী সঙ্গিনী, কি আনন্দদধ্বনি ভারত ভূমে, কে ও রণ রঙ্গিনী, প্রেম তরঙ্গিনী, জাগ মা কুলকুন্ডলিনী, পাঠিয়ে দে মা আনন্দময়ী, বিশ্ব প্রসবিনী ত্রিলোক পালিনী, শ্যামা মা তর পাগলা ছেলে। ১৯৩৪ খৃষ্টাব্দের ১৮ মে শুক্রবার মুকুন্দদাস মৃত্যু বরণ করেন।
পরের গন্তব্য বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ব্রজমোহন কলেজ। (চলবে)

পেয়ারা বাগান দর্শন, জ্যান্ত ইলিশ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ- প্রথম পর্ব

আরও দেখুন

এ বিষয়ের আরও সংবাদ

Close