জেলে ইলিশ মাছ শিকার করছে, জালে আটকিনো ইলিশ ছটফট করছে- এমন দৃশ্য সাধারণ মানুষ খুব বেশী একটা দেখার সুযোগ পায় না। যারা এটা দেখতে পায় প্রথমবারের মতো, তাদের আনন্দটা যে কেমন, তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না হলেও আধুনিক প্রযুক্তির ভিডিওতে সেই অনুভূতি ধরে রাখা সম্ভব। হয়েছে এমনটাই, আগস্টের ৩ তারিখ, কীর্তনখোলা নদীতে জেলেদের ইলিশ শিকারের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে উচ্ছ্বাসে মেতেছিলো ছোট বড় সকলেই। হিয়া, মাহি, ইকরা আর মুহতাসিম যে ভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে তেমনি করেছেন বয়স্ক ভ্রমণসঙ্গী বিলকিস, মুশরাত, মারুফা, নার্গিস এবং হেলেন। আমি অবশ্য এর আগে এমন দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছি বেশ কয়েকবার। তাদের সেই উচ্ছ্বাসের ভিডিও রয়েছে আমার কাছে, সুযোগমতো তা প্রকাশ করা যাবে।
এটা ছিলো আমাদের বরিশাল-পিরোজপুর-ঝালকাঠী ভ্রমণের শেষ বেলার কথা। এবার শুরু থেকে আলোকপাত করা যাক আমাদের ভ্রমণ কাহিনীর খানিকটা কথা।
১ আগস্ট বৃহস্পতিবার আমাদের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা থেকে ফারহান-৭ নামক বিশালকার লঞ্চে। সকলেই অবগত- ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছানোর কষ্টের কথা। কেউবা তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টায় সদর ঘাট পৌঁছেছেন, আমার লেগেছে পৌনে দুই ঘন্টা। যাত্রার সময় নিয়ে কিছুটা নাটকীয়তা করেছিলাম বলে সকলেই সময়মতো পৌঁছে ছিলো সদরঘাটে; সংশয় ছিলো হিয়াকে নিয়ে, কারণ ও আসবে উত্তরা থেকে, অফিস শেষ করে। সকলের দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে হলেও হিয়া ঠিক সময়ে পৌঁছে যায় ফারহান-৭ লঞ্চে। বলে রাখা ভাল আমাদের গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিলো দশ জন। নামগুলো ইতোমধ্যে জেনে গেছেন পাঠক।
সকলে মিলে মাস্টার ব্রিজের সামনে রাতের খোলা আকাশের নিচে হুল্লোর করে, গান গেয়ে, আকাশের তারা গুনে সময় কাটায়। অবশ্য দু-একজন অলস মানুষ থাকে গ্রুপে, যারা কেবিনে ঘুমিয়ে রাত কাটাতেই ভালবাসে- আমাদের সাথেও এমন জনা তিন/চারেক ছিলেন। বাকীরা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোর সোয়া তিনটায় আমরা পৌঁছে যাই বরিশাল সদরঘাটে। আমরা জেনেছিলাম সকাল চারটা, সাড়ে চারটায় সেখানে পৌঁছাতে পারবে; ঘটলো বিড়ম্বনা, লঞ্চ আমাদের নামিয়ে দিয়ে ঝালকাঠী চলে যায়, আমরা বসে থাকি টার্মিনালে, অভ্যর্থনাকারীর অপেক্ষায়।
হুমায়ূন (বরিশাল অঞ্চলের স্কাউট নেতা ও আমার ছোট বোনের বর) এলো সাড়ে চারটার দিকে, নিয়ে চললো রূপাতলী আঞ্চলিক স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, আমাদের আবাস হবে সেখানেই। পৌঁছেই সকলেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়, ফলে প্রথম দিনের ভ্রমণসূচির কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দশটার দিকে সকালের নাশতা হলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, যাত্র শুরু করতে প্রায় এগারোটা। প্রথম গন্তব্য ঝালকাঠীর কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ি। হামিম (আমার ছোট বোন) ম্যাজিক টেম্পু নিয়ে পেট্রোল পাম্পে অপেক্ষায় থাকে প্রায় একঘন্টা। সাথে ওর তিন বছরের কন্যা।
ম্যাজিক টেম্পু নিয়ে প্রথম দর্শন কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ি, অযত্ন অবহেলায় বাড়িটার অবস্থা এমন পর্যায়ে- সেটি ঘুরে দেখার মত পরিবেশ নেই। দুটি ভবন অবশ্য এখন স্কুলের দখলে; বাড়ির ভেতরে নতুন ভবন করে পুরো বাড়ির দৃশ্যপট বদলে দেয়া হয়েছে। ইতিহাস সচেতন মানুষ বা পর্যটক সেখানে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরবেন। এখানে পর্যটক এলে গাইড করার মতো একউ নেই, নেই কোন ইতিহাস বর্ণনা- আমাদের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কবে সচেতন হবে তা হয়তো ভবিতব্যও জানে না। জমিদার বাড়ির বর্ণনা বা ইতিতহাস এখানে বলে কলেবর বাড়াতে চাই না। আগ্রহীগণ একটু কষ্ট করলেই এই বাড়ির ইতিহাস জানতে পারবেন।
জমিদার বাড়ি থেকে আমরা ছুটলাম ভিমরুলী বাজারে, যেটি ভাসমান পেয়ারা বাজার হিসেবে পর্যটকেদর কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইদানিং। স্থানীয় বাজার কমিটি পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় কিছুটা শৃংখলা বজায় রাখার চেষ্টা করলেও ইঞ্জিন চালিত নৌকাগুলোর বেপরোয়া গতি এবং উচ্চ শব্দে ভিনদেশী গান ও মিউজিক পুরো এলাকার পরিবেশ বিপন্ন করে তুলেছে। এখানে তাজা পেয়ারা স্বাদ নিলো সকলে। গরমের মাত্র বেশী থাকায় শ্রাবণ কোথায় যেন হারিয় গেছে, খুঁজে পাওয়া গেল না। ছোট খাল, ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলোর বেড়রোয়া গতি যে কোন সময়ে বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। আমাদের সামনেই এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকবার। স্থানীয় ব্যবস্থাপকদের বারংবার নিষেধ সত্তেও তাদের দৌড়াত্ম কমে না। প্রশাসনকে শক্ত হতে হবে এখানে। প্রচুর দেশী-বিদেশী পর্যটক এখানে আসে, ফিরে গিয়ে সকলেই ঋণাত্মক মন্তব্য করবে সভাবতই। বেশ ঝুঁকিপূর্ণ নৌ-ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমাদের নৌকা পৌঁছে যায় আদমকাঠী পেয়ারা পার্ক খ্যাত ন্যাচারাল টুরিজম এন্ড পিকনিক স্পটে। ৩০ টাকা মূল্যের টিকিট কিনে এখানে প্রবেশ করতে হয়। বলে রাখা ভাল- আদমকাঠীর এই পেয়ারা পার্ক পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী উপজেলার কুড়িয়ানার অন্তর্ভুক্ত। মূলত আটঘর-কুড়িয়ানা-ভিমরুলী, এই তিন এলাকায় বিশাল পেয়ারা বাগান, ঝালকাঠী সদর ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠীর অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা থেকে সরাসরি লঞ্চে স্বরূপকাঠী এসেও নৌকা বা ট্রলারে পেয়ারা বাগান দেখা যায়। আমরা অবশ্য ভিন্ন কারণে ঝালকাঠীর ভিমরুলী থেকে যাত্রা শুরু করেছি। আরেকটা বিষয় জানিয়ে রাখা ভাল, আটঘর-কুড়িয়ানার ভাসমান পেয়ারা বাজার শুরু হয় সকাল ৬টার দিকে শেষ হয় ৯টার মধ্যে। ভিমরুলীর ভাসমান বাজার শুরু হয় ১০টার দিকে, চলে ১১/১২টা পর্যন্ত।
আদমকাঠীর পেয়ারা পার্কে পেয়ারা বাগানের ভেতরে গিয়ে গাছ থেকে পাকা পেয়ারা খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। জেনেছি, তিন যুবক এ উদ্যোগ নিয়েছেন পেয়ারা বাগানের মালিকদের কাছে থেকে বাগান লিজ নিয়ে। ভাল উদ্যোগ, তবে পর্যটকদের, বিশেষত স্থানীয় বেপরোয়া পর্যটকদের পেয়ারা গাছে চড়ে গাছের ক্ষতি করার প্রবণতা রোধ করতে হবে। এখানে সুন্দর একটা প্রথা চালু আছে, পার্কে ঢুকে আপনি যতখুশি পেয়ারা খেতে পারবে, তবে একটাও সাথে নিয়ে আসতে পারবেন না।
নৌকায় আমাদের সদস্যগণ বেশ আনন্দ করেছেন, পানিতে পা ভিজিয়েছেন, গলা ফাটিয়ে আনন্দ করেছেন- যা স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে সংগত কারণেই তারা করতে পারেন না। পেয়ারা বাগানের সাথে রয়েছে বরিশালের বিখ্যাত আমড়ার বাগান। আরো মাসখানেক পরে আমড়া বাজাড়ে আসবে, এখোন পরিপক্ক হয়নি আমড়া। চারিদিকে সবুজের সমারোহ ঢাকার সবুজহীনতার কষ্ট ভুলিয়ে দেবে আপনাকে, যেমনটা দিয়েছে আমাদের ভ্রমণসঙ্গীদের।
চুক্তি মোতাবেক ট্রলার আমাদের নামিয়ে দেয়ার কথা আটঘর বাজারে। ওরা বিশ্বাস ভঙ্গ করে আমাদের নামিয়ে দেয় জিন্দাকাঠী বাজারে, ফলে আটঘর পৌঁছাতে হয় ইজি বাইকে। এজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয় প্রায় দেড় ঘন্টা। বদলে যায় আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা। কষ্ট পেতে হয় দুপুরের খাবার পাওয়া নিয়ে। শেষ বেলায় আটঘর বাজারে কোন রকমের মুখে দেয়া মতো খাবার মিললো; দলের সদস্যরা নাখোশ, কিন্তু বলার কিছু নেই- অগত্যা হজম করা, এই আর কি!
আটঘরের খাবার কোনমতে মুখে গুজে আরেক ম্যাজিক টেম্পুতে যাত্রা শুরু হয় চাখারের উদ্দেশ্যে, শের-ই-বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের বাড়িতে- তাঁর ভিটে, স্মৃতি জাদুঘর, বাস ভবন দেখার জন্য।
সকলেরই জানা আছে, দক্ষিণ বাংলার ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার মহান ব্রত নিয়ে অবিভক্ত প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে চাখার ফজলুল হক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৮ সালে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। বলে রাখা ভাল, শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ১ এপ্রিল ১৯৩৭ থেকে ১ ডিসেম্বর ১৯৪১ এবং দ্বিতীয় দফায় ১২ ডিসেম্বর ১৯৪১ থেকে ২৯ মার্চ ১৯৪৩ পর্যন্ত কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হিসেবে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়ে বাংলার গভর্নর ছিলেন স্যার জন আর্থার হার্বার্ট এবং ভারতের ভাইসরয় ছিলেন দ্য মারকুইস অব লিনলিথগো।
চাখারে রয়েছে শের-ই-বাংলার বাসভবন, রয়েছে স্মৃতি জাদুঘর, তাঁর পিতার নামে স্কুল। আমরা দেখেছি তাঁদের পারিবারিক গোরস্থান। সত্যি কথা বলতে দক্ষিণ বাংলার এই মহান নেতা, যিনি আজো বাংলার ঘরে ঘরে “হক সাহেব” নামে পরিচিত, তার জন্মভিটা পরদর্শনের জন্য আজো ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। পর্যটন বিভাগ স্থানটিকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নিলে চাখার হয়ে উঠতে পারে ব্যস্ততম পর্যটন এলাকা। আমার মনে হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ শের-ই-বাংলা সম্পর্কে, তাঁর কর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত নয় বা জানার চেষ্টাই করে নি কখনো।
চাখার থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিলো উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়ায় অবস্থিত বাইতুল আমান মসজিদ। আধুনিক স্থাপত্যকলার সুন্দর এক নিদর্শন মসজিদটি। পর্যটকরা মসজিদের আলোকসজ্জা দেখার জন্য সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করে এখানে। গুঠিয়ার চাংগুরিয়া গ্রামের অধিবাসী এস, শরফুদ্দিন আহমেদ ২০০৩ সালে এটির নির্মান কাজ শুরু করেন এবং এর কাজ শেষ ঞয় ২০০৬ সালে। ৮ গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদের মিনারের উচ্তা ১৯৩ ফুট। ১৪ একর জমির উপর স্থাপিত এই মসজিদটিতে ব্যবহার করা হয়েছে উন্নমানের কাঁচ, ফ্রেম, বোস স্পিকার। মসজিদটির সীমানার মধ্যে রয়েছে ২০ হাজার অধিক ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন ঈদগাহ্, দিঘি, এতিমখানা, ডাকবাংলো, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, লেক, পুকুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বাগান রয়েছে। চাংগুরিয়া গ্রামে অবস্থিত হলেও এটি গুঠিয়া মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
প্রথম দিনের ভ্রমণ শেষ করে সন্ধ্যার পরে সকলের আশ্রয় হয় রূপাতলীর আঞ্চলিক স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। কেন্দ্রের মিজান-এর তত্বাবধানের সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় চলে দারুণ ভোজের আয়োজন। গ্রুপের সকলেই অন্যান্য নানাবিধ আয়োজনের সাথে কীর্তরখোলা নদীর তাজা ইলিশ খেয়ে দিনের সকল কষ্ট ভুলে যায় সহজেই।
(চলবে)
একটি মন্তব্য