সকাল পৌঁনে সাতটায় ময়মনসিংহ হতে সিএনজি যোগে রওনা হয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছলাম নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলায়। তেমন কোন চোখ ধাঁধাঁলো স্থাপনা না থাকলেও সকালের মনোরম পরিবেশ রাতের কম ঘুম হওয়াকে পুষিয়ে দিল। উপজেলা সদরে ছোট খাটো একটা বাজার। সেখানেই সকালের নাস্তা সেরে স্থানীয় কয়েকজনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেখতে গেলাম- রাজধলা বিল। তবে পূর্ব নির্ধারিত কাজ শুরুর তাড়া থাকায় স্বল্প সময়েই চলে আসতে হয়েছে। ১৩০ একর জুড়ে বিস্তৃত সেই রাজধলা বিল। সারাবছরই বিলে পানি একই রকম থাকে, তেমন কম-বেশী হয়না। এই বিলে কোন কচুরীপানা জন্ম নেয়না। বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখ জুড়ানোর মত। যাবার আগে তেমন টান অনুভব না করলেও তা দেখে ফেরার সময়ে আর ‘এট্টু সময়’ থেকে আসতে ইচ্ছে করেছিল।
পূর্বধলায় কাজ শেষে, দুপুর তিনটার কিছু আগে, রওনা হলাম অজানার উদ্দেশ্যে। অজানা বলার কারণ হলো- কোথায় আমায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা সম্পর্কে আমি তেমন অবগত ছিলামনা। তবে একটা স্থান ঠিক করা ছিল; আর তা হলো- চিনামাটির পাহাড় দর্শন। পূর্বধলা থেকে বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল সেন্টারের দূরত্ব প্রায় ২৪ কিলোমিটার। মটর সাইকেলে চল্লিশ মিনিটেরমত সময় লাগলো। বিরিশিরি মূলত: দূর্গাপুর উপজেলার আওতাধীন। প্রকৃতি পরম মমতায় এলাকাটিকে আগলে রেখেছে। সেখানকার কালচারাল সেন্টারের স্থাপনাগুলো দাঁড়িয়ে আছে; তবে ভ্রমন পিপাসুদের আকৃষ্ট করতে, প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে, আরো পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।
বিরিশিরি থেকে তিনালি বাজার আর ফাড়ংপাড়া ঘুরে এবার মোটর সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম সুমেশ্বরীর বুকে। অপরূপা সুমেশ্বরী নদীটি নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলা দুর্গাপুরে অবস্থিত। নদীটি অত্যন্ত খরস্রোতা; ভারতের মেঘালয় রাজ্য হতে উৎপত্তি হয়ে বিজয়পুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুমেশ্বরী নাম ধারণ করেছে । এই নদী হতে বালি, কয়লা, পাথর উত্তোলন করে এলাকার শত শত মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। দেশব্যাপি সুমেশ্বরীর বালির ব্যাপক চাহিদা। এই নদীতে এক সময় মহাশুল মাছ পাওয়া যেত। ভাঁটার সময় নদীটির তিন-চতুর্থাংশ বালুকাবেলা পায়ে মাড়িয়ে পাড় হতে হয়। আমাদের এবারের গন্তব্য কিন্তু জানা- বিজয়পুর সীমান্ত।
সুমেশ্বরী পাড় হয়ে বিজয়পুরের পথে সাধু যোসেফের চার্চ মোটর সাইকেলে প্রায় এক ঘন্টার পথ। মুল সড়ক থেকে পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে চার্চ পর্যন্ত আঁকাবাঁকা স্যাঁতস্যাতে রাস্তাটি একটু সতর্কতার সাথে পেড়োতে হয়। চার্চের গেইটে কেউ না থাকায় এবার আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলোনা। কুল্লাগড়ার সেই সাধু যোসেফ চার্চে ঢোকা গেলোনা! শুনলাম ভেতরে পরিপাটি একটি মিশন আছে। মিশনের সামনে মেরীর প্রতিকৃতি গড়া আছে। ফিরে চললাম বিজয়পুর চেকপোস্ট অভিমুখে। বেশ কাঠখড়ি পেরিয়ে বিজয়পুর ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা একজন বিজিবি অফিসারের অনুমতিক্রমে সীমান্ত পর্যন্ত যাবার অনুমতি মিললো। তবে এবার সাথে মোটর সাইকেল সাথে নিতে পারলাম না। তবে সেখানকার স্ট্যান্ড থেকে ব্যাটারি চালিত টমটমযোগে দুলতে দুলতে চললাম সীমান্ত অভিমুখে। তিন কিলোমিটার পথ। যাওয়া আসা করতেই কেটে গেলো পৌঁনে এক ঘন্টা। বিজয়পুর চেকপোস্টের সাথে কয়েকটি দোকানে সীমিত আকারে পাওয়া যায় ইন্ডিয়ান সাবান, শ্যাম্পু, বডি স্প্রে আর চকলেট। যা হোক সবশেষে আমাদের এবারের যাত্রা সেই কাঙ্খিত চিনামাটির পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।
বিজয়পুর সীমান্ত হতে সাদামাটির খনিতে যাবার নতুন পিচঢালা পথটি চমৎকার। কয়েকদিন আগেও নাকি রাস্তার বেহাল দশা ছিল! সহযাত্রী জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ভাষায় এটি মেরিন ড্রাইভ। জাহাঙ্গীর ভাই বেশ বন্ধুপ্রিয় মানুষ। একসময় ঢাকায় ক্লাব পর্যায়ে গোলকিপার হিসেবে তিনি ফুটবল খেলতেন। ফুটবল শৈলীর কারণে বেশ নাম ছিল তাঁর। পরিবারের প্রয়োজনে গ্রামে ফিরে এসে ১৯৯৯ সালে যোগ দিয়েছেন পূর্বধলা’র জগৎমনি স্কুলে। স্কুলের খ্যাতি বিস্তৃতিতে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রেখেছেন পেছন থেকে। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের একপাশে সাগর; অন্য পাশে পাহাড় আর জনবসতি। তবে এই পথের পুরোটা জুড়ে একপাশে ইন্ডিয়ান বর্ডারের পাহাড় আর অন্যপাশে আমাদের সাদামাটা গ্রামীন জনবসতি। আধাঘন্টার কম সময়ে জনবসতির মাঝ দিয়ে এবার পৌঁছলাম সাদামাটির খনিতে। জানতে পারলাম এখানে এমন খনির সংখ্যা বেশ কয়েকটি। এ জেলার উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বিজয়পুরের সাদামাটি। ১৯৫৭ সালে ভূতত্ত্ব জরিপে বিজয়পুরের এ মাটির সন্ধান পাওয়া যায়। একটি খনি দেখে বগাউড়া বাজার সংলগ্ন সবুজ অরণ্য পেরিয়ে যখন বিজয়পুরের আদি চিনামাটির পাহাড়ে পৌঁছলাম তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়ছে। চিনামাটির খনির পাশে লেক সদৃশ জলাভূমিতে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে অযু সেরে আসরের নামাজ আদায় করা হলো খোলা আকাশের নীচে দুর্বা ঘাসের উপর। এরপর দ্রুত ফটো স্যুট করে ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম।
চারপাশের আলো ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। শিবগঞ্জ বাজারের খেয়াঘাটে এবার পাড় হলাম সেই সুমেশ্বরী। দ্রুত এগিয়ে চলছি পূর্বধলার উদ্দেশ্যে। কারণ, পূর্বধলা থেকে ময়মনসিংহ এবং সেখান থেকে রাতেই ফিরব ঢাকায়। এর মাঝে দক্ষিণ আকাশে কালো মেঘ জমছে। ঠান্ডা বাতাসে উপলব্ধি হলো দূরে বৃষ্টি হচ্ছে। উৎরাইল বাজারে পৌঁছে মাগরিবের নামাজ শেষে সামনে এগুনো কিংবা না এগুনোর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। অবেশেষে হ্যাভারস্যাকে রেইনপ্রোটেক্ট কাভার লাগিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। ক্ষাণিক পথ এগুতেই দেখা মিললো বৃষ্টির সাথে! অল্পক্ষণেই একেবারে চুপসে গেলাম বৃষ্টির পানিতে। বর্শার মত তীক্ষ্ণ বৃষ্টির ফোটায় ভিজে একাকার! মোটর সাইকেল চলছে। পাশ দিয়ে হেডলাইট জ্বালিয়ে সাঁ সাঁ করে বড় বড় ট্রাক পাশ কেটে যাচ্ছিল। পিছনে বসে আস্তে গাড়ি চালানোয় জাহাঙ্গীর ভাইকে বারবার সতর্ক করছিলাম। এরই মধ্যে বৃষ্টির পানিতে মাথার চুল চুপচুপে ভিজে গেছে। কিছুক্ষণ চলার পর গত্যন্তর না দেখে থামলাম গোয়াল পাড়ায়। এবার মাথায় দেয়ার জন্য পথের পাশের দোকান থেকে সংগ্রহ করলাম পলিব্যাগ। জাহাঙ্গীর ভাইও পলিব্যাগ নিয়ে নিলেন তার মোবাইল আর ম্যানিব্যাগ বাঁচানোর জন্য। প্রায় বিশ মিনিট ধরে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে; বৃষ্টির সাথে কথোপকথন শেষ করলাম। বিরতিহীনভাবে তখনও মোটর সাইকেল চলছে। এর মাঝে বাতাসে কিছুটা কাপড় শুকালো। আধা ভেজা কাপড়ে রাত আটটায় পূর্বধলা চৌরাস্তায় পৌঁছলাম। সেখান থেকে দেড় ঘন্টায় ময়মনসিংহ পৌঁছে; তারপর রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
এ এলাকায় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অপ্রতুল। ব্যক্তিগত বাহনে যোগাযোগ করতে হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অপ্রতুলতা দূর করা গেলে আর এখানকার সৌন্দর্যের বিষয়ে ব্যাপক প্রচার করা গেলে- এলাকাটি হয়ে উঠতে পারে পর্যটনের নতুন ঠিকানা। মোহনগঞ্জের পর নেত্রকোনায় এবার দ্বিতীয় ভ্রমন হলেও ইতোমধ্যে তৃতীয় ভ্রমনের মনস্থির করতে হয়েছে। কারণ এ এলাকার বিখ্যাত বালিশ মিষ্টি নাকি সদরে পাওয়া যায়। আর তৃতীয়বার নেত্রকোনা যাবার কারণ অনন্ত: সেটিই।