আব্বা প্রফেসর মোহাম্মদ কামরুল হুদা। রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কন্ট্রোলার। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। টাকা-পয়সার দরকার হলে আব্বার অফিসে গিয়ে বসে থাকি। আব্বা চট করে টাকা দিতে পারতেন না। তিনি হিসাব-নিকাশ করতেন। টাকা জোগাড় করতেন। অল্প কয়েকটা টাকা, তাও আব্বাকে জোগাড় করে দিতে হতো। আমি মৎস্য শিকারির অসীম ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করতাম।
আব্বার অফিস রুমে অপেক্ষা করছি। আব্বা গম্ভীর মুখে কাজ করছেন। তিনি তাকিয়ে আছেন টেবিলে রাখা কাগজের দিকে। হাতে কলম। স্বাক্ষর করছেন। আমাকে দেখেছেন কিনা বুঝতে পারছি না। আমার দিকে একবারও তাকাননি। আব্বাকে কিছু বলতে পারছি না। তাঁকে ভীষণ ভয় পাই। আব্বাকে যিনি কাজে সহায়তা করেন তার নাম বাবর আলি। তিনি আমাকে দেখেছেন। চোখের ইশারায় বসে থাকতে বলেছেন। আমি রুমের একপাশে চেয়ারে চুপচাপ বসে আছি। রুমে আরও কয়েকজন আছেন। তারা কলেজ থেকে এসেছেন। কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ। আমার তাড়া আছে। টাকা নিয়ে চলে যাব। উসখুস করছি।
আব্বা মুখ তুলে সামনের দিকে তাকালেন। কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেবকে বললেন, “বলুন।” প্রিন্সিপাল আর ভাইস-প্রিন্সিপাল সাহেব এগিয়ে এসে আব্বার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে রাখা চেয়ারে বসলেন। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, “স্যার, নতুন কয়েকটা রেজিস্ট্রেশন ছিল।” আব্বা বললেন, “টাকা এনেছেন?”
আমি চমকে উঠেছি। আব্বা আমাকে দেখেছেন কিনা নিশ্চিত হতে পারছি না। আব্বা ঘুষ চাইছেন! আমার কানের ভেতর মনে হচ্ছে কেউ তপ্ত তরল লোহা ঢেলে দিয়েছে।
প্রিন্সিপাল সাহেব বিশেষ উৎসাহ নিয়ে বললেন, “জি স্যার এনেছি। আপনার টাকা, চেয়ারম্যান সাহেবের টাকা সব আলাদা করে এনেছি।”
আব্বা বললেন, “বের করেন।”
লজ্জায়, ক্ষোভে, কষ্টে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আব্বা ঘুষ খাচ্ছেন! তার মানে আব্বা নিয়মিত ঘুষ খান! নিশ্চিত হয়েছি আব্বা আমাকে দেখেননি। দেখলে অন্তত আমার সামনে ঘুষের টাকা নিতেন না। উত্তেজনায় আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আব্বার ঘুষের টাকায় আমরা কয় ভাই-বোন পড়াশোনা করছি, এটা মেনে নিতে পারছি না।
আব্বা বললেন, “টাকা বের করেন।”
আমি এক পা এগিয়ে গেছি। আমাকে এক্ষুণি কিছু করতে হবে। আব্বাকে জাপটে ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার সাহস আমার নেই। আজ আমাকে সেটাই করতে হবে। আমি সাহস বোধ করছি।
প্রিন্সিপাল সাহেব ব্রিফকেস খুলে টাকা বের করেছেন। অনেক টাকা।
আব্বা বললেন, “বাবর আলি, দরজা বন্ধ করো।”
বাবর আলি আব্বার অফিস রুমের দরজা বন্ধ করল। আব্বা থানায় ফোন করলেন। প্রিন্সিপাল আর ভাইস-প্রিন্সিপাল ঘটনা বুঝতে পারছেন না। পুলিশ চলে এসেছে। টেবিলের ওপর খোলা ব্রিফকেসে টাকা। প্রিন্সিপাল, ভাইস-প্রিন্সিপাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেল।
পরে জেনেছি আব্বা এরকম চল্লিশটা কেস করেছেন। আব্বা আমাকে বললেন, “টাকা কি আজকেই লাগবে? খুব দরকার না হলে আগামীকাল বিকেলে আসিস।”
টাকা আমার আজকেই লাগবে। আমার কাছে টাকা নেই। শহর থেকে ভার্সিটিতে ফিরতে দশ টাকা রিকশা ভাড়া। আমার কাছে কোনো টাকা নেই। ভার্সিটির বাসে ফেরা যায়। বাস আসতে দেরি আছে। বাসায় গিয়ে আম্মার কাছ থেকে বিশ তিরিশ টাকা নেওয়া যায়। টাকার জরুরি দরকারের কথা আব্বাকে বলতে পারলাম না।
আব্বার রুমে এখন আর কেউ নেই। বাবর আলি বেরিয়ে গেছেন। আব্বার রুমের দরজা বন্ধ। ঘরে শুধু আব্বা আর আমি। আব্বা কী যেন ভাবছেন। আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বুকের ভেতর উষ্ণতা অনুভব করছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ শহর থেকে হেঁটে ভার্সিটিতে ফিরব। দূরত্ব হবে ৫-৬ কিলোমিটার।
আব্বা মানিব্যাগ থেকে দুটো দশ টাকার নোট বের করে আমাকে দিলেন। বললেন, “আজ এই নিয়ে যা। আমার কাছে টাকা নেই।”
বিশ টাকা নিয়ে আব্বার অফিস রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আবেগী সিদ্ধান্ত, ঠিক করলাম এই দুটো দশ টাকার নোট আমি কোনোদিন খরচ করব না।
আব্বা চাকুরি থেকে রিটায়ার করার আগে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আব্বাকে দেখতাম রিটায়ার করার পর টেম্পুতে চড়ে যাতায়াত করেন।
আমাদের অনেক টাকা-পয়সা ছিল না, কিন্তু আমরা কখনোই মানসিকভাবে দরিদ্র ছিলাম না। এখনো নই। এই ঘটনা সম্ভব হয়েছে আব্বার জন্য। আব্বার জন্য ভালোবাসা।