বাংলাদেশি ডাক্তারদের ওপর দেশের আপামর জনগণের বেজায় গোস্বা। আমি নিজে ডাক্তার হয়েও,এই প্রজাতির ওপর বেশ নাখোশ এবং ত্যক্ত বিরক্ত। তবে আনন্দের কথা কি জানেন? এই ডাক্তারকুল যখন নিজে রোগি হন,তখন তারা হন সবচেয়ে অবহেলিত রোগি। সাধারণ অসুখ বিসুখে তারা নিজেরাই ২টি ট্যাবলেট গিলে ফেলেন। মাঝারি ধরণের অসুখে তারা নিজেদের বিশেষজ্ঞ বন্ধুদের একটা ফোন করে ওষুধের নাম জেনে নেন। ডাক্তার বন্ধুটি তাকে কোনরকম পরীক্ষা নিরীক্ষার ঝামেলার মাঝে না ফেলেই, মুখে মুখে ওষুধের নাম বলে দায়সারা গোছের একটা ঝাড়ি মেরে, ‘আরে গাধা,তুই বেটা ডাক্তার হইছস কেন? এই মুহূর্তে মেডিসিন শুরু কর।সবকিছুতে খালি অবহেলা।’ বলেই, ‘আরেকটা কল এসেছে রে,পরে কথা বলছি, ওষুধপত্র ঠিকমতো খাস কিন্তু।’ ফোনটা কেটে দেন। অথচ এই ডাক্তার সাহেবই অন্য রোগিদের বেলায় গাদা গাদা টেস্ট লিখে আগে পাঠান ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এতে অবশ্য ধনী রোগিদের উপকারই হয় বেশি আর গরিব হয় সর্বস্বান্ত। আর যদি কোন ডাক্তার কঠিন রোগে আক্রান্ত হন, তখনই পড়েন বিপদে। বিখ্যাত ডাক্তার সাহেবরা চেম্বারে ডাক্তার রোগি দেখে তাদের মূল্যবান সময় ও অর্থের অপচয় করতে চান না। সোজা ফটক থেকেই পত্রপাঠ বিদায়। তাদের এ্যাসিস্টেন্টরা বলে দেন,‘স্যার চেম্বারে ডাক্তারদের দেখেন না, আপনি হাসপাতালে দেখা করবেন।’ বিখ্যাত ডাক্তার সাহেবের ভয়, যদি এই ডাক্তার তাকে ফিজ না দেন। তিনি তো চাইতে পারবেন না। অোর চাইলেও বদনাম হয়ে যাবে। কী দরকার এই ঝামেলায় গিয়ে। কারণ, মেডিকেল এথিকসে পরিস্কার নির্দেশ আছে, কোন ডাক্তার অন্য কোন ডাক্তার, তাদের বাবা মা, স্ত্রী, সন্তান রোগি হয়ে এলে তাদের কাছ থেকে কোনপ্রকার ফি নিতে পারবেন না। যদিও আজকাল বেশিরভাগ ডাক্তারই এসব এথিকস ফেথিকসের ধার ধারছেন না। তাদের মন্তব্য দেশে এতো এতো ডাক্তার, আবার তাদের পরিবার পরিজন সবাইকে বিনে পয়সায় দেখলে,পথে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নামতে হবে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিছু কিছু চিকিৎসক এখনও নিয়মটা মেনে চলছেন এবং ভিক্ষাবৃত্তি না করেই জীবনযাপন করছেন। আমার পরিচিতই অনেক ডাক্তার আছেন যারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে ঐসব বিখ্যাত চিকিৎসকের সিরিয়াল নিয়ে তাদের কাছে দেখিয়ে ফি দিয়ে আসেন এবং সতর্ক থাকেন কোনক্রমেই যেন তার ডাক্তার পারিচয়টি ফাঁস না হয়ে যায়। কথাবার্তায় যেন মেডিকেল টার্ম বেরিয়ে না আসে। কারণ যদি পরিচয় বেরিয়ে আসে তবে তিনি বঞ্ছনা আর অবহেলার শিকার হবেন।তাদেরকে বলা হবে,‘হাসপাতালে আসুন’। কিন্তু হাসপাতালে ঐ চিকিৎসকের টিকির দেখা পাওয়াও দুস্কর। আমি নিজেও ভুক্তভোগি। তখন আমি ছোট ডাক্তার,মানে মাত্রই পাশ করে বেরিয়ে সরকারি চাকরি করছি। পড়লাম কঠিন অসুখে। নিজেদের চিকিৎসা ফেল। গেলাম বড় প্রফেসর সাহেবের কাছে। তিনি আবার আমার সরাসরি শিক্ষক এবং আমার ডাক্তার বান্ধবীর বাবা। তিনি বোধহয় ভেবেছিলেন আমি কোন টাকাপয়সা দেবো না, তাই কোনরকমে সাধারন পালস, ব্লাড প্রেসার আর বুকে স্টেথো ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা পর্ব শেষ করে প্রেসকিপশন লিখতে বসলেন। আমি করুণ গলায় বললাম,‘স্যার, (ডাক্তার ছাড়া অন্য কেও ডাক্তারদেরকে সাধারনত স্যার সম্বোধন করে না।), আমার তো মনে হচ্ছে নার্ভাস সিস্টেমে গন্ডগোল,আপনি তো ওটা পরীক্ষা করলেন না।’ তিনি বিব্রত বোধ করে আমতা আমতা করে বললেন,‘তুমি নিজে ডাক্তার তো, তাই মনে হবে পৃথিবীর যত কঠিন কঠিন রোগ তোমার হয়েছে।’ তবে ভুলটা স্বীকার না করে পরোক্ষভাবে সকল রোগের ধন্বন্তরী স্টেরয়েড প্রেসক্রাইব করে দিলেন। আসার সময় তার হাতে ফিজের টাকাটা দিতেই তিনি অন্যদিকে চেয়ে টাকাটা পকেটে পুরলেন। আমি বিস্ময় নিয়ে তার মুখের দিকে একবারও না তাকিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল। প্রফেসরের চিকিৎসায় আমার রোগ সারলো না। রোগ আরও বাড়লো, আমি শয্যাশায়ী। এরপরের ঘটনা আরও করুণ। চট্টগ্রাম থেকে বদলী হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে এলেন এক প্রফেসর (লোকে বলে তিনি শিক্ষিত হাতুড়ে, সাধারন ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসাও জানেন না, এ ঘটনা পরে বলবো আরেকদিন), মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান। আমি আর আমার স্বামীও তখন ঐ একই মেডিকেলের ডাক্তার । তিনি প্রাইভেট কলে বাসায় গিয়ে রোগি দেখেন,তাই আমার স্বামী ও ডাক্তার বান্ধবীরা তাকে অনুরোধ করলেন,আমাকে একবার এসে দেখে যেতে। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। আমার স্বামী তারপর আমাকে প্রায় কোলে করে হাসপাতালে তার চেম্বারে নিলেন। তিনি নিতান্ত অবজ্ঞাভরে আমাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, আমাকে শুনিয়েই এমন এক রোগের নাম বললেন, যে রোগে মানুষ বাঁচে না। আমার স্বামী এবং অন্য ডাক্তাররা উনাকে বললেন, ‘স্যার আস্তে বলুন।’ এ কথা শুনে তিনি আরও জোরে জোরে আমার মৃত্যসংবাদ ঘোষণা করতে লাগলেন। সবার মুখ কালো হয়ে গেলো। আমার দ্রুত মৃত্যুর খবরে নয়, একজন মৃতপথযাত্রীর সামনে তার মৃত্যু পরোয়ানা এরকম নগ্নভাবে ঘোষনা করার কুৎসিৎ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে। আমি কিন্তু ঘাবড়াইনি, হাসি হাসি মুখে সবার কালো মুখের দিকে তাকাচ্ছি। এটা দেখে সবাই আরও ঘাবড়ে গেলো, কারণ প্রফেসর সাহেব যে রোগের নাম বলেছেন, সেই রোগে আক্রান্ত রোগিরা সবসময় হাসিখুশি থাকে। আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম, ‘আমি নিশ্চিৎ, আমার এটা হয়নি।’ তারপর এলাম ঢাকায়, নিওরোমেডিসিনের প্রফেসরকে দেখালাম, তিনি পাঠালেন নিওরোসার্জারীতে। আত্মীয়স্বজনরা বলতে লাগলেন একবার তখনকার বিখ্যাত এক প্রফেসরকে (পরে যিনি জাতীয় অধ্যাপক হয়েছিলেন) দেখাতে। তখন তো আর বুঝতাম না জাতীয় অধ্যাপক, স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক পেলেও চিকিৎসক হিসেবে ভালো ও মানবিক না ও হতে পারেন। এখন এসব বুঝি। গেলাম তাঁর চেম্বারে, তার এ্যাসিস্টেন্ট আমরই মত এক ছোট ডাক্তার, রাস্তা থেকেই আমাদের বিদায় করলো এই বলে, ‘স্যার ডাক্তারদের চেম্বারে দেখেন না, হাসপাতালে দেখাবেন।’ অনেক অনুরোধেও তাঁর মুখদর্শন করা গেলো না। এটা একধরনের চালাকি, সে সময় ডাক্তাররা এতোটা চক্ষুলজ্জাহীন হয়ে ওঠেনি, সরাসরি ডাক্তারের কাছ থেকে ফিজ নিতে পারতেন না, তাই এধরনের ভনিতা। হাসপাতালে তাঁর টিকি বা লেজের দেখা আর পাইনি। সে অনেক অনেক আগের কথা। এখন বলি ২০০৮ এর কথা, আমি বড় হয়েছি, আমার বন্ধুবান্ধবরাও বড় বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, প্রফেসর, আমার স্বামী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হর্তাকর্তা, তার অধীনে সমস্ত সরকারি ডাক্তার কর্মচারি। আমার প্রথম ২টি বই বের হয়েছে সবেমাত্র ২০০৮ এর একুশে বইমেলায়। সারা রাত জেগে মশার কামড় ভ্রুক্ষেপ না করে, স্ক্রিপ্ট তৈরি, বারবার প্রুফ দেখা, একচুলও যেন ভুল না হয়, সে কী উত্তেজনা। ফলাফল, প্রচুর প্রশংসা আর আনন্দের সাথে হলাম ডেঙ্গু আক্রান্ত। তাও যে সে ডেঙ্গু নয়, প্রাণঘাতি হেমোরেজিক, যমে মানুষে টানাটানি। ঢাকা মেডিকেলের ভি.ভি.আই.পি কেবিনে ভর্তি হলাম। আমার বন্ধুবান্ধবসহ ঢাকার সমস্ত সরকারি ডাক্তাররা ছুটে এলো আমাকে এক নজর শেষ দেখা দেখতে। গম্ভীর মুখে প্রফেসররা বোর্ড বসালেন, ঘন ঘন মত পাল্টাতে লাগলেন। আমি অজ্ঞান অবস্থায়, মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে এলে ঘোর লাগা চোখে চেয়ে দেখি কেবিন ভর্তি লোকজন, আমার ডাকসাইটে প্রফেসর ডাক্তার বান্ধবীরা মাথার কাছে বসে কোরআন পড়ছে। অন্তিম অবস্থা আমার। প্রফেসররা কল করলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পূর্বতন পিজি হাসপাতাল) মেডিসিনের ডীন, এক প্রফেসরকে। তিনি ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞ, পত্রপত্রিকায় ডেঙ্গুর ওপর বাঘা বাঘা আর্টিকেল লিখছেন। তিনি এলেন না। পিজি তো আর এখন সরকারি হাসপাতাল নয়, তিনিও সরকারি চিকিৎসক নন। সরকারি হলে অবশ্যই আসতেন। আমার প্রফেসর ডাক্তার বান্ধবীরা ছুটে গেলো তার কাছে। তিনি বললেন, ‘এই রোগি তো বাঁচবে না, গিয়ে কী লাভ?’ ঠোঁটকাটা এক বান্ধবী বলে বসলো, ‘মরনাপন্ন রোগিই যদি না দেখেন, বাঁচানোর চেষ্টা না করেন, ভালো রোগি তো সবাই চিকিকৎসা দিয়ে ভালো করতে পারে, তবে আর আপনি কীসের বিখ্যাত ডাক্তার। তাছাড়া এই রোগি একজন ডাক্তার,আপনারই প্রফেশনের মানুষ।” না, এলেন না আরব্যরজনীর তিনি। তবে আরব্যরজনীর আলাদিনের দৈত্যের মতোই কারিশমা দেখালো হাসপাতালের ছোট ছোট ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয় ও অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারিরা। ১৮ ব্যাগ রক্ত শরীরে ঢুকিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে উঠলাম আমি। আল্লাহর কী কুদরৎ, অশেষ মেহেরবানী। রাখে আল্লাহ মারে কে? কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম রক্তে সুগার বেড়েছে। সবাই বললো, ‘ব্যাপার না, ডায়াবেটিস কোন রোগই নয়।পরিমিত আহার, নিয়মিত ব্যায়াম, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন আর বারডেমের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নিয়মিত পরামর্শ, গাইড বই,ব্যস। কিন্তু আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা বড়ই চিনিহীন(অমধুর),তাই আর অচিনির (ডায়াবেটিসের ) ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। পরিমিত আহার, নিয়মিত ব্যায়াম আর নিজের প্রেসক্রিপশনেই চলছি। দেখা যাক চিনি কতদূর চিনিহীন হয়। তবু মধুহীন মুখ, মনের ডাক্তারদের কাছে এই অব (আমি এখন অবসরপ্রাপ্ত) সময়ে গিয়ে আর অবমাননার গ্লানি পেয়ে মনটা ত্যক্ত বিরক্ত করতে চাইনা। বলেছিলাম না, ডাক্তাররা হলো সবচেয়ে অবহেলিত রোগি। অনেক গ্রাম্য ধনী পরিবারের মহিলা পুরুষ রেগিদের দেখি ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে সম্বোধন করছে, ‘এই ডাক্তর’ ডাক্তার সাহেবও সে ডাক শুনে হাসিমুখেই উত্তর ও চিকিৎসা দিচ্ছেন, নগদ নারায়ন পেলেই তো হলো। আর ডাক্তাররা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ‘স্যার’ বলেও গম্ভীর মুখই দেখেন আর অবহেলার শিকার হন, যদিও রোগি দেখার পর এথিকস বিরোধী ফিজটাও দিয়ে আসেন। হায় রে ডাক্তার যখন রোগি, স্বামী যখন আসামী, স্ত্রী তখন বিচারক।