বিনোদন

আজ আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস

জিয়াউদ্দীন চৌধুরী

নৃত্য হচ্ছে মানুষের মনোজাগতিক প্রকাশভঙ্গি। কেননা নৃত্য ও এর ভাষা কাজ করে একসূত্রে। আজ আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। পৃথিবীর সব নৃত্যশিল্পীর কাছে আজকের দিনটি তাৎপর্যবহ। সারা বিশ্বে প্রতি বছরের ২৯ এপ্রিল নানা উৎসব-আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়। প্রতিবারের মতো চলতি বছরেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিনটি। ১৯৯২ সালে দিবসটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশেও পালিত হয়ে আসছে দিবসটি।
১৭২৭ সালের এই দিন বিশ্ব নৃত্য সংস্কারক জ্যঁ জর্জ নোভেরের জন্মগ্রহণ করেন প্যারিসে। তিনি ১৭৫৪ সালে ব্যালে নৃত্য আবিষ্কার করেন। এর পর ১৭৬০ সালে রচনা করেন ‘লেটারস অন দ্য ড্যান্স’ গ্রন্থ। এ গ্রন্থে ব্যালের ব্যাকরণ ও উপস্থাপনা বিষয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। নোভের ব্যালে রচনার পাশাপাশি ব্যালের বিন্যাস, নির্দেশনা, পোশাক সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। সেসব রীতি আজও বহাল আছে। ব্যালে আবিষ্কার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ব্যালে, আমার অবিরাম পড়াশোনা, নিরীক্ষা ও কর্মতৎপরতার ফসল। আমি ব্যালে নৃত্যের সামান্য উন্নতির কথা ভেবেছিলাম, যা মানুষের শিল্পরুচিতে প্রভাব ফেলেছিল। সে সময় আমার চিন্তা অনেকেই অমানবিকভাবে গ্রহণ করেছিল।’ ব্যালের শেক্সপিয়ার হিসেবে পরিচিত নোভেরের মোট কম্পোজিশন ১৫০টি। ওই সময় তার কম্পোজিশন পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। জ্যঁ জর্জ নোভের ওই সময় অনেক শিল্পসমালোচক তার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তার সমকালীন সমালোচকদের আগ্রহ ছিল- জ্যঁ জর্জ নোভেরের এই চিন্তাধারা কীভাবে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছিল সে সম্পর্কে। জর্জ নোভের ব্যালে রচনার পাশাপাশি ব্যালের বিন্যাস, নির্দেশনা, পোশাক সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল নৃত্যশিল্পী, বাদক, শিল্পনির্দেশক সবার সমন্বয়। সেসব রীতি আজও বহাল আছে। তবে তার ব্যালে প্রচারের সময় সমালোচকরা বিভিন্ন তর্ক তুলেছিলেন। সে সম্পর্কে নোভেরও চমৎকার এক ব্যাখ্যা দেন; তিনি বলেনÑ ‘আমার অবিরাম পড়াশোনা, নিরীক্ষা ও কর্মতৎপরতার ফসল ব্যালে নৃত্য।
আমি নৃত্যের সামান্য উন্নতির কথা ভেবেছিলাম, যা মানুষের শিল্পরুচিকে প্রভাবিত করেছে। আমার চিন্তা অনেকেই অমানবিকভাবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু ব্যালে নৃত্য একদিন নিজ শক্তিতে প্রতিষ্ঠা পাবে, হয়তো সেদিন আমি থাকব না। হয়তো সেদিন অনেকেই এর পরিমার্জনে অংশ নেবে।’ পরবর্তীকালে নোভেরের ব্যালের ব্যাপক পরিমার্জন করেন ইতালির নৃত্যবিদ ডাবরভেল ও সেলভেটর ভিগেনোর। তবে তাদের শিক্ষক নৃত্যবিদ কার্লো ব্লাসিস নোভেরের সৃষ্টিকে সুমহান মর্যাদা দিয়েছিলেন। ১৭০০ সালের মাঝামাঝি নোভের প্রভাবিত হয়েছিলেন ম্যারি সেলের প্রতি। ব্যালের ক্ষেত্রে ম্যারির স্বাধীন ধারণা এবং আবেগীয় গুরুত্ব তাকে আকর্ষণ করেছিল।
তিনি অনুভব করেছিলেন একজন নৃত্যস্রষ্টার কাছ থেকে শুধু নৃত্যের কৌশল আয়ত্ত করা যথেষ্ট নয়, বরং সেগুলো বাঁচিয়ে রাখাতে সংকল্প থাকতে হবে। জর্জ তার স্ত্রী অভিনেত্রী মার্গারেট সাভিয়রের সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। সে সময় শিল্পসমালোচক গ্রেকিক নোভেরকে আখ্যা দেন ‘ব্যালের শেক্সপিয়ার’। জর্জ নোভের ১৭৬৭-৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভিয়েনায় এবং ১৭৭৪-৭৬ সাল পর্যন্ত মিলেনে কর্মরত ছিলেন। ফ্রান্স-বিপ্লবের পর তিনি লন্ডনে এসে কিংস থিয়েটার সেমিনারে বক্তব্য দেন। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন পি গার্ডেল, অ্যারটোনি বুনোবিয়েল, মেরি গেয়েমার্ড ও ভেরিরি ডিডিলট। নোভেরের দেওয়া ধারণাগুলোকে কেন এত বৈপ্লবিক মনে করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। নোভের ছিলেন কোরিওগ্রাফার (বিন্যাসক/বিন্যাসকারী)। নৃত্য বিষয়ে পড়াশোনা ও অনুশীলন শেষ করে ১৭৪৩ সালে তিনি ‘পারি ওপেরা কোমিক’-এ শিল্পী হিসেবে যোগ দেন।
পরের কয়েকটি বছরে তিনি বার্লিন, ড্রেসডেন ও স্ট্রসবুর্গে নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। স্ট্রসবুর্গেই ভাবী স্ত্রী ও অভিনেত্রী মার্গারেট সোভারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এর পর মার্সেইতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি চলে যান লিওঁ নগরীতে। সেখানে তিনি তার প্রথম দিককার ব্যালেগুলোর কোরিওগ্রাফি করেন। এর পর তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যালে প্রদর্শন করেন। অবশেষে আবাস গাড়েন লন্ডনে। লন্ডনে তখন কোনো ফরাসি বিষয় বরদাশত করা হতো না। কিন্তু সে কালের বিখ্যাত অভিনেতা গেরিক নোভেরকে নৃত্যের শেক্সপিয়ার মনে করতেন। নোভের লন্ডনেই থেকে যান এবং গোপনে ব্যালেশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। নোভের ১৭৬৭-৭৪ সাল পর্যন্ত ভিয়েনায়, ১৭৭৪-৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি মিলেনে কর্মরত ছিলেন। শেষ জীবনে তিনি ফ্রান্সে বসে নিজের চিঠিপত্রের নতুন একটি সংস্করণ সম্পাদনা করেছিলেন।
তিনি ভাবতেন নৃত্য অত্যন্ত জটিল একটি ব্যাপার। ছবি ও রঙের মতো। চিত্রকর্মের বিচিত্র রূপের সঙ্গে নৃত্য বিন্যাস ঘটে। পরে এর প্রকাশভঙ্গি আলোর সমকক্ষ চিন্তা করা যেতে পারে। সংগীত ব্যতীত নৃত্য বোধগম্য নয়। সৃজনশীল উপায়ে সব দেহটাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং দেহের ছন্দকে মানুষের কাছে তুলে ধরা জরুরি। আর একটা জিনিসের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন, সেটা হলো অভিব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে আত্মার গতিশীল আলোড়ন ফুটে ওঠে মুখম-লের মাধ্যমে। অব্যশ্যই একজন নৃত্যশিল্পীকে অন্য দশজন মানুষ ছাড়া পৃথক হতে হবে। তা হলে একজন শিল্পীর চমৎকার রুচি অন্যদের আকর্ষণ করবে। নোভেরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যালের মধ্যে রয়েছে অ্যাডমিটেড অ্যারসেট, লে মোট দ্য হারক্লি, মিড ইট জ্যাসন, দ্য পাস্ট অব হিউম্যান, ডিয়ার লেস অ্যাজামনুন, অ্যাপলস ইট ক্যাম্পপেসপে প্রভৃতি। ১৮১০ সালের ১৯ অক্টোবর নোভেরের প্রয়াণ ঘটে।
তার অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কো ১৯৮০ সালে তার জন্মদিন ২৯ এপ্রিলকে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস ঘোষণা করে। তখন থেকে পৃথিবীব্যাপী এ দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৯১ সাল থেকে এ দিনটি বিশেষভাবে পালন করে। ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কাউন্সিল বাংলাদেশ শাখা ও বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা যৌথভাবে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠান পালন করে। ওইদিন সকালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমি থেকে বিশেষ শোভাযাত্রা বের হয়। সর্বস্তরের নৃত্যশিল্পীর অংশগ্রহণে এ শোভাযাত্রা শহীদ মিনার, প্রেসক্লাব প্রদক্ষিণ করে। আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে ২০০৩ সাল থেকে ২৩-২৯ এপ্রিল দেশব্যাপী নৃত্য উৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা।
এছাড়াও টিভি চ্যানেলগুলোতে নৃত্য দিবস উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। সেখানে অংশ নেবেন দেশের তারকা নৃত্যশিল্পীরা।

আরও দেখুন

এ বিষয়ের আরও সংবাদ

Close