কবিতা

যুদ্ধ, স্বধীনতা ও আমি

মোঃ হুমায়ূন কবীর

উনিশ শো একাত্তর- বয়স কতই বা তখন আমার
নয় বা দশ বসরের দুরন্ত ডানপিটে কিশোর বেলা
হঠাৎ মার্চের পরন্ত বিকেলে শুনি স্বধীনতার ডাক-
থমথমে পরিবেশ ছিল স্বরূপকাঠীর দিন রাত,
শুনি একদিন যুদ্ধ শুরু হয়েছে- ছাব্বিশে মার্চ।
বাবার মুখে শুনলাম- ঢাকাতে মারছে নীরিহ মানুষ
পাকিস্তানের হানাদার এসে এ দেশের জনগন।
স্কুল হলো বন্ধ, সে কি আনন্দ-
গুলতি দিয়ে পাখী মারা, শালিক ছানার খোজে-দত্তবাড়ী,
চৌধুরী বাড়ীর বনে ঘোরা। সে এক মহা উল্লাস,
যেন পেয়েছি স্বাধীনতার স্বাদ।
একদিন বাবা ডেকে বললেন- শোন খোকা, এভাবে তুমি
আর যাবেনা বাউরে, পাক হানাদার বাহিনী এসেছে হেথা।।
ইন্দেরহাট আর স্বরূপকাঠী করেছে বিভাজন সন্ধ্যা নদী
দুই কুলেতেই ছিল গর্ব মোদের, সুন্দরবনের কাঠের ব্যাবসায়-
দেশ জোড়া সুনাম নিয়ে, রত্নগর্ভা হয়ে নিজে নিজেই।
পাক হানাদার ঠাই নিল এসে, স্বরূপকাঠীর শর্ষিনা র্পীরের বাড়ীতে।
নাম দিল তারা পাকিস্তান- স্বরূপকাঠীর পূর্ব পাড়,
হিন্দুস্হান হলো ইন্দের হাট- সন্ধ্যা নদীর পর্শ্চিম পাড়ের।
আর দু’টো গ্রাম ছিল- আটঘর আর কুড়িয়ানা,
হিন্দু বসতি সেথা ছিল তাদের- পূর্ব পুরুষের আবাস ভূমি।
দেশ জোড়া নাম ছিল তাদের পেয়ারা চাষের
সেই গ্রাম দু’টো ছিল কোপানলে- তারা জন্মেছে হিন্দু বলে।।
আমি দেখেছি সেই ছোট্ট কালে, কিশোর বেলায় –
যুদ্ধ, স্বাধীনতা, মানুষের লাশ- নিজের মতো করে।
প্রতি সন্ধ্যায় শুনেছি গুলির শব্দ এসেছে ভেসে
স্বরূপকাঠী স্কুলের পর্শ্চিম থেকে সন্ধ্যা নদীর তীরে
বাড়ীর বড়রা বলতো তখনি- মারলো না জানি কার সোনামনি
পাক হানাদারের হাতে! পরদিন ভোরে লুকিয়ে লুকিয়ে
ছুটে যেতাম মোরা বন্ধুরা মিলে, সন্ধ্যা নদীর তীরে।
গতকাল রাতে কি হোয়েছে সেথা, দেখিতে নিজের চক্ষু দিয়ে।
দেখিতাম নদীর অগভীর খাঁদে, রয়েছে দু’চারটি লাশ উপুর হোয়ে
যায়না কাহারেও চেনা, হায় অভাগা মানুষগুলো
মরলি এভাবে নিজের দেশে, পরাভূত হোয়ে বিদেশীদের হাতে?
কি দোষ ছিল তাদের কেউ জানেনা, যুদ্ধ লেগেছে বলে।
আমি দেখেছি সে যুদ্ধে লুট করে নিয়ে আসা-
গরু, ছাগল, ভেড়া- আটঘর কুড়িয়ানাতে চলতো রোজই –
হিন্দু মারার পালা, পাক বাহিনীর তদারকিতে
রোজই নিয়ে যেত ঘর ঘর থেকে পালা করে
লোক দিতে হত লুটের তরে- তা না হোলে মারবে পাকিরা
জীবনের এই ঋৃন শোধ করিতে- যেতে হতো তাদের সাথে।
দেখেছি বহু লোক নৌকায় ভরে নিয়ে এসেছে ভেঙ্গে বাড়ীঘর,
থালা বাটি সম্বল যা পেয়েছে সম্মূখে- খেলনা, লাটিমও দেখেছি আমি
ঐ লুটেরাদের কাছে। কত স্মৃতি বিজরিত
সংসার গুলো হোল মরুদ্যান, তাদের ব্যাথা বুঝেনি তো কেহ,
হায়রে অভাগার দল। আমি দেখেছি তখন
হানাদারেরর দেয়া আগুনের লেলিহান,
চৌধুরী বাড়ী, সমদ্দার বাড়ী পুড়ে হল ছাড়খার।
ইন্দের হাটে বহু বাড়ী ঘরে দিয়েছে আগুন, মেরেছে মানুষ
ধরে ধরে এনে, মুক্তি বাহিনী আছে নাকি সেথা
লুকিয়ে লুকিয়ে করছে নাকি বাংলা মায়ের সেবা।
অনেক মেরেও ক্ষ্যান্ত হয়নি পশু হায়ানার দল
এক বাড়ীতে মারল তারা সাতটি মানুষ মহা উল্লাসে
মাটি হোল তাদের এক কবরে, স্মৃতি হয়ে রইলো তারা-
“সাত ব্যাক্তির এক কবর” ফলকে আজো হয়ে অম্লান ।।

মনে পরে আজো -মিলিটেরী এলো বলে দৌড়াচ্ছে সবে
মায়ের হাত ধরে সবাই চলেছি অজানার উদ্দেশে
আবার ফিরেছি বাড়ী ভয়ে ভয়ে সবে
কি জানি কি হোল আজানার টানে
গানবোট আর মেশিন গানের গুলীর শব্দ মিলিয়ে গেলে দুরে।
অভাব কারে কয়? দেখছি আমি মানুষের ঘরে ছিল নাকো খানাপিনা
লবন বানাতে দেখেছি আমি কলা গাছের বাকলের-রস বের করে
তা হাড়িতে জ্বাল দিয়ে। দেখেছি ক্ষুধার তাড়নায়
বাড়ীর অনেকেই রেখে যেত মায়ের কাছে
রান্নাঘরে হাড়ি বাটি যা ছিল তাদের
ভাতের মাড় যদিবা কিছুটা মেলে।
মাকে দেখতাম- মাড়ের সাথে দিয়ে দিত সে যে,
কিছুটা রান্না করা ভাত মিসিয়ে সেই মাড়ের সাথে।
প্রতিদিন সাঁঝে ছিল উঠানে মোদের
বড়দের সভা ও পরামর্শ, সায়েরা ছ’ব্যান্ডের রেডিওটি ছিল
মধ্যমনি হয়ে সবার ভক্ত। শুনিতো তাহারা মনোযোগ দিয়ে
স্বধীন বাংলা -বেতার কেন্দ্রের খবর, বাপ চাচা আর খালুরা সবাই মিলে।
ওদিকে দেখিতাম মা চাচীরা মিলে- বসিতো সবাই হুকো পান সাজাতে
রেডিও শুনতো আর হুকো ফুকতো লম্বা লম্বা টানে
পিতলের হুকো আর লম্বা সোনালী পাইপে –
দেখিতে লাগিত বেশ, রাশভারী কথা শুনতাম শুধু
বাবা চাচা খালুদের মুখে বেশ।
রাত শেষ হোত শঙ্কা আর ভয়ে সূর্য উঠিত পূব আকাশে,
শুনিতাম গতদিনের কত কাহিনী, কাকে মারলো, ধরে নিয়ে গেল,
মুক্তিবাহিনী কোথা কি করেছে, সেই বীরত্ব সব কাহিনী।।

হঠাৎ একদিন সকালে উঠিয়া শুনিলাম সবে বলিতেছে যে কথা,
দেশ নাকি কাল হয়েছে স্বাধীন- পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে,
মুক্ত নিজের অধীন। সে দিনটি ছিল এত সাধনার,
একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর। এর ঠিক দু’একদিন বাদে
স্বরূপকাঠী হয়েছে স্বাধীন, মনে পড়ে আজো সেদিনের কথা
কল্পলোকের মতো, মুজিব বাহিনী আর মুক্তি বাহিনী মিলে
যুদ্ধ করিল পাক বাহিনী, রাজাকার আর আল বদরের সাথে
ছিনিয়ে আনলো স্বাধীনতা তারা, শর্ষিনার পীরের বাড়ী থেকে
সেদিন আমিও ছিলাম জয়ের কাতারে মুজীব বাহিনীর বড় ভাইরা
নিয়েছিল মোরে সংঙ্গী করে, তাদের সাথে পীরের বাড়ীর
আস্হানাতে অস্র উদ্ধারে। মুজীব বাহিনীর হেড কমান্ডার
নূর মোহাম্মদ ডেকে বললো মোরে, তুমি কি নেবে বহন করে
আমাদের ক্যাম্পেতে? তুলে দিল সে-দুকাধে দুটো
এসএমজি আর এসএলআর; বহু আনন্দে এনেছিলাম টেনে,
বিজয়ের সাধ বুঝিনি তখনো- সারি দিয়ে সবে চলেছি আমরা,
মুখে ছিল জয় বাংলার শ্লোগান, ছোটকালের এই বিজয় আনন্দ
ভোগ করেছি বড় হোয়ে যেন, ভাবছি তা আজ বার বার।।

জাতি তে আমরা নাম লিখে দিলাম
চির স্মরণীয় করে রাখলাম, যা পারেনি দুনিয়ার
অনেক স্বধীনতাকামী দেশ, স্বাধীনতা আছে অনেক দেশেরই
বিজয় দিবস নাই তাদের দেশেতে, আমরা কিন্তু দু’টোরই মালিক
ভেবেছো কখোনো কি কেউ? লাল সবুজের পতাকা পেলাম,
পেলাম স্বাধীন বাংলাদেশ।।

আজ এতদিন পরে ভাবি মনে মনে
স্বাধীনতা তুমি কি?
সঙ্গা খুজেছি অনেক আমি যে, উত্তর মেলেনি-
পেয়েছে কি তারা মনের শুদ্ধি, স্বাধীনতার সকল প্রাপ্তি,
তবুও আশার বুক বেধে আছি, হয়তো পাবে অনাগত জাতি,
যা পাইনি আমরা জীবিতরা আজও, পাবে তারা আগামী।।

আরও দেখুন

এ বিষয়ের আরও সংবাদ

আরো দেখুন

Close
Close