গল্প

একা মানুষ

মোঃ সাইদুর রহমান

• আমার নাম ফজর আলী
লোকটির  নির্লিপ্ত উত্তর । বাজারের মোড়ে ভিক্ষে করতে দেখি রোজ। বয়স সত্তুর থেকে আশি হতে পারে লিকলিকে লালচে শরীরে হাড়ের উপর শুধু ঢিলঢিলে চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই।
• এখানে কি চাই?
• তিনদিন ধইরা খাই না।
• কেন ভিক্ষা করেন না।
• বান বাতাইশ্যা দিনে ভিক্ষা করতে বাইর হইতে পারি না।
তাইতো গত তিন চারদিন যাবৎ বর্ষার অবিরাম বর্ষণ চলছে।
সিড়ি ঘড়ে বসতে দিয়ে ভেতরে এসেছিলাম । তারপর দুদিন বুড়ো আর যায়নি। সিড়ি ঘড়েই রয়েছে। রেনু কাজের মেয়েটাকে ‍দিয়ে খাবার পাঠাচ্ছে। পুরোনো কাথা আর মশারী ‍দিয়েছে ঘুমোতে। দুদিন পর আজ ছাদে যেতেই সিড়ি ঘরে দেখা। জানতে চাইলাম নাম কি?
• বাড়ি কই?
• আমার বাবা বাড়ি ঘর নাই।
• পরিবার ?
• পরিবারও নাই। একা মানুষ।
মানুষ কখনো একা হতে পারে । চারপাশে এতো এতো মানুষ তার পরও কিছু মানুষ বলে, আমি একা মানুষ।
এই একা মানুষ টিকে আমার ভাল লাগল। আমি একজন নাট্যকার । নাটকের প্রয়োজনে গল্প খুজে বেড়াই। সেই কৌতুহলেই লোকটাকে জানতে ইচ্ছে করল।
• চলুন ছাদে যাই।
নিঃশব্দে আমার পিছু পিছু ছাদে এলেন। কাঠের টুলটায় বসলেন আমার মুখোমুখি।
• কি করে আপনি একা হলেন?
• আমরা সবাই ই একা হেসে উত্তর দিলেন।
একা আসছি একা যাব। মাঝের সময় টুকুই একা একা থাকতে বড় কষ্ট হয় তাই না।
• আপনার পরিবারে কেউ ছিল না? বাবা মা ভাই বোন?
– ছিল, সবাই ছিল । হারায়ে গেছে জনাব।
– কি ভাবে হারালো?
– অনেক বড় ঘটনা।
– বলেন আপনার অনেক বড় ঘটনা শুনি।
অনেকটা অনিচ্ছায়ই শুরু করলেন-
আমার মা আছিল যাত্রা পালার নটি। যাত্রা পালায় নাচগান করত। সেই যাত্রা পালার পেন্ডেলেই আমার জন্ম। মা নাম রাখছিল, লালচাঁন।
অধিকারী কইল চান্দের মত পোলা হইছে অমন সুন্দর নাম রাইখ না নজর লাগব। অর নাম রাখ কালু। আমারে কোলে নিয়া মায় গঞ্জে গঞ্জে ঘুইরা বেড়াইতো।
আমার যখন দুই বছর বয়স তখন মায় এক কৃষকের হাত ধইরা আমারে লইয়া যাত্রাদল ছাইরা চইলা আসে। তার নাম ছিল করিম মিয়া। আমাগ গেরামের বাজারে তার চায়ের দোকার আছিল। তারেই আমি বাবা বইল্যা ডাকি। জীবনে আদর আর ভালবাসা আমি তারথন ই পাইছি।
চোখের জল লুঙ্গির কোনায় মুছল। আমি তাড়া দিলাম
– তারপর?
প্রতিদিন সকালে বাবার কান্দে চইড়া বাজারে যাইতাম। দুপুরে ফিরতাম । বাবায় আমারে মুড়ালি সন্দেস রোজই কিন্না দিত। মায় মানা করত কিন্তু শুনতো না। এই সময় বাবায় দোকানদারির লগে লগে নিজের খেতে খামারে ও কাম শুরু করল। মায় বাড়িতে হাঁস, মুরগী গরু পালতো। সুখের সংসার আছিল আমাগ। আমার আরো তিন বইন ও দুই ভাই হইল। দুইডা বইন মইরা গেল আতুর ঘরে। এক বইন ও দুই ভাই আস্তে আস্তে ভাংগর হইল। কেউ হাটে কেউ বহে কেউ দৌড়ায়। ঘর ভরা সুখ। এমন সময় একদিন এক রাইতের পেটের ব্যাদনায় মায় মইরা গেল। ছোট ছোট পোলা মাইয়া লইয়্যা বাবায় পড়ল বিপদে। বাবায় হারাদিন ক্ষেতের কাম আর দোকানের কাম শ্যাষ করে। আমি ভাই বইন লইয়া খেলি। বিকালে বাপে পুতে মিল্লা রাইন্দা খাই। আমাগ দেহনের কেউ আছিল না। উপায় নাই দেইখা বাবায় আবার বিয়া করে। আমার নতুন মায়ের নাম ফরিদা। বাবার লগে লগে প্রথম প্রথম আমি ও ফরিদা কইয়া ডাকতাম। বাবায় বুঝতো, ছয় সাত বছরের ডাংগর পোলা আমি। অচেনা এক মহিলারে মা ডাকতে মুখে বাজে। বাবায় আমারে ডাকদিয়া কইল নাম ধইরা ডাকে না বাপ। আম্মা কইয়া ডাকবা।
সেই থাইকা আমি তারে আম্মা কইয়া ডাকি। আম্মার লগে সংসারের বেবাক কামই করি। মাঝে মাঝে ছোড ভাই বইন লইয়া পাশের গ্রামে আম্মার বাপের বাড়িতে বেড়াইতে যাই। নানা নানি মামু খালা বেবাকতেই আমারে আদর করে। আমার ভাই বইনরে আদর করে। আম্মাই আমারে প্রথম জুম্মাঘরে আরবি পড়তে পাঠায় । প্রথম দিন হুজুরে জিগায়-
• তোর নাম কি?
• কালু।
• এইডা কেমন নাম। তুই করিম মিয়ার পোলা না?
• হ ।
• তোর মায়রে গিয়া কইবি মুসলমানের নাম কি কালু হয়?
• তোর সুন্দর একখান নাম রাখবি।
মায়রে কইলে মায় কইল তর হুজুর রে কাইল বেহানে আইতে কইস । পরদিন বেহানে হুজুর রে লইয়া বাড়িতে গেলাম। মায় আড়াল থাইকা কইল। হুজুর আমার পোলাডার একটা নাম রাইখাদেন। হুজুরে জিগাইল আপনার নাম কি?
• ফরিদা।
• তাইলে আপনের নামের লগে মিলাইয়া রাখলাম ফজর আলি।
আমার আম্মার ঘরে ও আমার দুই বইন আর এক ভাই হইল। আমরা এখন মোট চার ভাই তিন বইন। আমি মাশাল্ল্যা এখন ডাংগর হয়ছি। বাবার দোকানে বসি, ক্ষেতে কাম করি, আম্মার লগে সংসারের কামও করি।
একদিন রাইতে বাবায় জ্বর লইয়া বাড়ি ফিরল। চোখ মুখ লাল। আম্মারে কইল
• আমি ডরাইছি। চিতা খোলার বটগাছটার তলে কি জানি দেইখা ডরাইছি। আমারে গোসল করা।
সারা রাইত ছটফট কইরা ভোর রাইতে বাবায় মইরা গেল। যাওনের আগে আমারে কইল
• কালুরে বাজান আমার ।
আমি উত্তর দিতে পারি না। বুক ফাইট্টা কান্দন আহে।
• অগরে দেখিস।
গলা ধরে এলো বুড়োর। থেমে গেল সে। আমি সহানুভুতির হাত তার কাধে রাখলাম।
বাবার মরণের পর আমি যেন অনেক খানি ডাংগর হইয়া গেলাম। বাবার সব কিছুই দেইখা রাখি। আম্মায় সারাদিন কান্দে। আমার ছোড বইনডা দুধ ছারান দেয় নাই। আম্মার লগে অয়ও হারাদিন ট্যা ট্যা কইরা কান্দে। মামুরা আহে। আম্মারে লইয়া যাইতে চায়। আম্মায় সংসার ফালাইয়া, আমাগ ফালাইয়া যায় না।
বছর খানিক পর একদিন এমনই বান বাতাইস্যা রাইতে দোকান থন বাড়িতে আহি নাই। বেহানে বাড়িতে আইয়া দেহি শ্যাস। রাইতে আম্মারে জাইত সাপে কাটছে। সুন্দর মুখখান তার নীল হইয়া রইছে। দুপুরের আগেই আম্মারে মাটি দিলাম। তার পর ছোট ছোট ছয় ভাই-বইন লইয়্যা পরলাম মহা বিপদে। দুধের বইন ও ছোট ভাইডারে দিয়া দিলাম মামুগো বাড়িতে । মামিরা পাইল্লা একটু ডাংগর কইরা দেউক। আমার পিডা পিডি ভাই দুইটা ডাংগর হইছে। একা একা থাকতে পারব। অগরে দিলাম গঞ্জে এতিম খানা মাদ্রাসায়। লেহাপড়া শিক্ষা মানুষ হউক। বাকি দুই বইন লইয়া আমার সংসার।
থেমে একটু কেশে নিল বুড়ো।
• তারপর
• অগ সবাইরে আমি লেখা পড়া শিখাইছি। বইন তিনটারে প্রাইমারী পাশ করাইয়া বনেদি ঘড়ে বিয়া দিছি। এক ভাই মাওলানা হইছে । এক ভাই এই শহরেই থাকে সরকারী চাকরী করে। এক ভাই ঠিক মত লেখা পড়া করে নাই। খালি স্কুল পাশ দিছে। বাবার সেই ছোট চায়ের দোকানডারে বড় মুদি দোকান বানাইয়া তারে দিছি।
আর আপনি?
আমি বাপের হাউত্তা পোলা। বাপের কোন সম্পদই পাই নাই। ভিটার একহাত জায়গাও অরা আমারে দেয় নাই। তাই সব ছাইড়া শহরে আইছি। প্রথম প্রথম রিক্সা চালাইতাম। এখন ভিক্ষা করি।
বিয়া করেন নাই?
করছিলাম। ভাই-বইন আর সংসার দেখতে গিয়া অনেক বয়স কইরা বিয়া করছিলাম । বছর খানিক বাদে বউ পলাইছে। তার ধারনা আছিল আমি সন্তান দিতে পারুম না।
• ভাই-বোনরা খোজ নেয় না।
• তারা খোজ নেয় না। আমিই সবার খোজ খবর লই। যখন বাবার শেষ কথা ডা আমার কানে বাজে
“অগরে দেখিস”।

আরও দেখুন

এ বিষয়ের আরও সংবাদ

আরো দেখুন

Close
Close