ব্যাগ খুলেই চমকে উঠলাম। মনে হল যেন একটি কালো কুচকুচে জাতিসাপ বসে আছে ব্যাগের কানায়। সকালেই বাড়ি থেকে হোস্টেলে ফিরেছি। ক্লাশ শেষ করে এই পড়ন্ত বিকেলে সব গোছ গাছ শুরু করেছি অমনি ব্যাগের ভিতর দেখলাম তারের গোছাটা।
সেই ছেলেবেলায় পাশের বাড়ির লাইনম্যান কাকু কয়েক হাত তারের টুকরো একদিন ছুরে দিয়ে বলেছিলেন নে এটা দিয়ে খেলিস। বলেই সাইকেল চালিয়ে মাঠের মধ্য দিয়ে চলে গেলেন। আমি তারের টুকরো গুলো হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই মা বললেন –
– কোথায় পেলি এগুলো।
– কাকু দিল।
– ও মা এতো দেখছি ডপার। এগুলো দিয়ে কি করে জানিস?
– না, মা
– টেলিফোনের লাইন টানে। তুই টেলিফোন দেখেছিস
– হ্যা, বাবার অফিসে।
বিকালেই মা তারের টুকরো গুলো জোড়া দিয়ে উঠানের এ মাথা থেকে ও মাথা টানটান করে টাঙ্গিয়ে দিয়ে বললেন
– এখন আর রোদে কাপড় শুকাতে কষ্ট হবে না। পাটের দড়িগুলো কত তারাতারি নষ্ট হয়ে যায়।
মা যে কি না। সবকিছুতেই তার সে কি আনন্দ।
লাইনম্যান কাকুর ছেলে বাবুল ভাই আমাকে শিখিয়েছিল কি করে এই তার গুলো খেকে তামার তারটি বের করতে হয়। সেই তামা টুকুর অনেক মূল্য। সেই তামা দিয়ে আচার, কটকটি কিংবা আইসক্রিম পাওয়া যায়। বাবুল প্রায়ই ওর বাবার কাছ থেকে তার চুরি করে পাশের জঙ্গলে রেখে আসতো। তার বেশি জমলে আর হাতে কিংবা দাতে কেটে তামা বের করা যেত না। তার গুলো তখন আগুনে পুড়িয়ে তামা বের করা হত। বাবুল ভাইয়ের সাথে থাকলে আমাকেও কিছু কিছু তামার ভাগ দিত। কয়েক দিনের তামা একত্র করলেই নগদ একটাকায় বিক্রি করা যেত। তাই দিয়ে স্কুলের গেট থেকে মনের মত সব খাবার । সেই লোভেই বাবুলের পিছু পিছু ঘুরতাম।
কিছুদিন পরেই আমাদের বাড়িতে ইলেট্রিসিটি এলো । দুরে কিছু অফিসার্স কোয়াটার হয়েছে। সেখান থেকে অনেকেই এই ডপারের তার দিয়ে নিজ দায়িত্বে কানেকশান নিয়ে নিচ্ছে। বাবাও একদিন নিল। এ জন্য লাইন ম্যান কাকুর কাছ থেকে একশ টাকা দিয়ে দুই রোল তার কিনতে হয়েছে। লাইনম্যান কাকুর পুরোটাই লাভ কারন তার গুলো চোরাই।
বাড়িতে ইলেট্রিসিটি আসায় সন্ধা হলেই ভাই-বোনেরা হইচই করে পড়তে শুরু করে দেই।
মাথার উপর ঝুলছে ষাট ওয়াটের বাল্ব। মায়ের কষ্টটা অনেক কমেছে। প্রতিদিন সন্ধায় আশেপাশের বেশ কিছু পরিবারের ছেলে-মেয়েরা মায়ের কাছে পড়তে আসতো। মা কোন মাইনে নিত না। অবশ্য মাইনে দেবার সামর্থ্য ও ওদের ছিল না। ওরা শুধু প্রত্যেকে নিজ নিজ হ্যারিকেন বা কুপি নিয়ে আসত। এখন একটি বাল্বর আলোতে সবাই একসাথে পড়তে পারছে।
জঙ্গলে বসে তার পোড়াতে গিয়েই একদিন দেখি পাশের বাড়ির ডলি আপার আর ও পাড়ার ফরিদ ড্রাইভারের ছেলে আলম ভাই জড়াজড়ি করে দাড়িয়ে আছে। আমি কৌতুহলি হতেই বাবুল ভাই আস্তে বলল, তাকাস না ওগিকে। চলে আয়। বাইরে বেরিয়ে বাবুল ভাই কে জিঙ্গেস করলাম ।
– ওরা অমন করছে কেন? ওদের কি হয়েছে?
– ওরা ভালবাসা করছে। তুই বড় হলে বুঝবি।
– এখন বুঝিয়ে বল।
– চুপ, বাবুল ভাই ধমকে ওঠেন।
আমি আর কথা বাড়াই না। প্রতিদিন কিছু তামা পাবার লোভে চুপ করে থাকি।
ডলি আপার ভালবাসা বেশি দিন গোপন থাকে না । একদিন সকালে ডলি আপার আত্মচিৎকার ছুটে যাই তাদের বাড়ি। ডলি আপার বাবা সেই তার দিয়ে চাবুকের মত করে ডলি আপাকে উঠোনে ফেলে মারছেন। সাপের ফনার মত শখপাং শপাং শব্দে তারের এক একটা বাড়ি তার শরীরে পড়ছে আর সে চিৎকার করছে উহ কি ভয়ংকর ।
বিকেলে মায়ের সাথে আবার ও বাড়িতে গেলাম মুলি বাঁশের বেড়ার ঘরে চৌকিতে ডলি আপা উপুর হয়ে শুয়ে তার কামিজ টা তুলে মা মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন। বেড়ার ফুটো দিয়ে দেখছি ডলি আপার সাদা পিঠটা চিতা বাঘের মত কালো ডোরা কাটা । মলম ছোয়ালেই শিউরে উঠছেন যন্ত্রনায়। উহ কি বিভৎস দৃশ্য। দুটুকরো তারকে দড়ির মত মুড়িয়ে দু মাথা জোড়া দিয়ে একটা কাঠের ছাতার বাট লাগিয়ে চাবুক বানালাম। চাবুকটা বাতাসে মারলেই শপাং শপাং শব্দ হত। আর আমি মনে মনে ডলি আপার বাবাকে মারছি ভেবেই খুশি হতাম।
বছর পেরিয়ে যখন নতুন ক্লাশে উঠলাম তখন আমাকে আর বুবুকে পড়াতে বাড়িতে প্রাইভেট মাষ্টার রাখা হল । বাবার অফিসের এক ইয়ং কলিগ আমাদের রোজ সন্ধায় পড়াতে আসেন। সামান্য একটু ভুল হলেই স্কেল দিয়ে মারতেন । আমি ও শুন্যে চাবুক ছুরে মনে মনে তাকে রক্তাক্ত করতাম।
মনে মনে আমি বাবাকেও তারের চাবুক মারতে শুরু করলাম। বাবা ইদানিং প্রায়ই মায়ের সাথে ঝগড়া করে । বিশ্রী সব কথা বলে গালি গালাজ করে, মারধোর করে। বুবুকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম –
– বাবা মাকে মারে কেন রে?
– সে তুই বুঝবি না।
– বল না ।
– বাবা মা কে সন্দেহ করে।
– কি সন্দেহ?
– বাবার ধারনা মা স্যারকে ভালবাসে । বুঝলি।
– না।
– তোকে ওসব বুঝতে হবে না। বলে বুবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আমি মনে মনে স্যারকে আরো বেশি বেশি চাবুক মারি। তার জন্যই তো মাকে এতো গালমন্দ শুনতে হচ্ছে। মার খেতে হচ্ছে। একদিন মাষ্টার মশাই চাবুক টা কেড়ে নিল । বুবুই ধরিয়ে দিল ।
– কিরে পড়া শেষ হয়নি তোর । স্যার ধমকে উঠলেন।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম-
– না।
– সারা দিন করিস কি তুই?
বুবুই বলে দিল আমি সারাদিন কালো তারের ওই চাবুকটা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। স্যার সেদিন চাবুকটা নিয়ে গেলেন। বুবুর উপর কি যে রাগ হয়ে ছিল । প্রতিজ্ঞা করে ছিলাম বড় হয়ে ওর মাথার সবচুল কেটে নেব।
তারের গোছাটা দেখে কত কি মনে পড়ছে আজ।
বুবুটা যে কিনা। কখনোই আমাকে বুঝতে চায় না। হোস্টেলে আসার সময় ব্যাগে নিশ্চয়ই তারের গোছাটা ও-ই দিয়ে দিয়েছে।
অথচ ও জানে এই তার টাকে আমি ঘৃণা করি। এটা কে আমি প্রচন্ড ভয় পাই। মানুষ কত কিছুই না ভয় পায়। কেউ তেলাপোকা, কেউ মাকরশা আবার কেউ বা টিকটিকি । কিন্তু আমি ভয় পাই এই কালো তারটাকে, সেই সে দিন থেকে যেদিন স্কুল থেকে আমি আর বুবু ফিরে দেখি ঘরের মধ্যে বাঁশের আড়ায় কালো তারটা গলায় জড়িয়ে শূন্যে ঝুলে আছে মা।