ফেরার পালা। চায়ের তেষ্টা যেমন পেয়েছে, তেমনি প্রচন্ড গরমে নিমোর পেল ঠান্ডা পানির তেষ্টা। ফিরতি পথে গাড়ী থামিয়ে ঠান্ডা পানি সংগ্রহ করা হলো। নিমো কিছুটা পানি মাথায় ঠেলে নিয়ে বাকীটা পান করলো। শাকিল অবাক হলো- আমি ঠান্ডা পানি পান করি না শুনে। আরো খানিকটা সময় পার করে, পথের দুধারে শালবন অতিক্রম করে নিমোর গাড়ী থামলো। আমরা ঠাঁই নিলাম মা-বাবা নামের একটা রেস্টুরেন্টে। স্থানটা দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যপাড়া এলাকার ভাদুরী বাজারে। জল-খাবারের মাঝেই ঠিক হলো আমরা মধ্যপাড়া কিঠন শিলা প্রকল্প দেখতে যাবো। যদিবা এটা জানাছিলো, পূর্বানুমতি ছাড়া এ প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ সম্ভব নয়। নিমো বললেন, চেষ্টা তো করে দেখি, পারলে দেখবো, না হলে ফিরে আসবো- আগো তো যাই। চমৎকার কঠিন মনোভাব। আমার বেশ পছন্দ হলো। গাড়ী ছুটে চললো মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পের পথে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রকল্পের গেটে আটকে দেয়া হলো। আমাদের জানানো হলো, অফিস থেকে অনুমোদন নিতে হবে। ভাবনায় ফেলে দিলো আমাদের। নিমো এবং শাকিল ভাবতে শুরু করলো, ভেতরে রংপুরের কেউ আছেন কি না। এমন সময়ে আমরা দেখা পেলাম দৈনিক ইনকিলাব-এর পার্বতীপুর উপজেলা প্রতিনিধ এম এ জলিল সরকারের সাথে। তিনি নিমোর পরিচয় পেয়ে জানালেন একজনের কথা, যাকে বললে ভেতরে যাবার অনুমতি মিলতে পারে। জলিল সাহেবই ফোন করে কথা বলে নিমোকে দিলেন। কথা হলো এবং ভেতরে যাবার অনুমতি মিললো। জলিল সাহেবকে গাড়ীতে তুলে নেয়া হলো। দেশের একমাত্র কঠিন শিলা প্রকল্প দেখতে ধীরে ধীরে গাড়ী চললো প্রকল্পের সংরক্ষিত এলকার ভেতরে।
যার কল্যাণে এ প্রকল্প এলকায় প্রবেশের অনুমতি পেলাম, তিনি সৈয়দ রাফিজুল ইসলাম- প্রকল্পের অন্যতম ব্যবস্থাপক। প্রথমে তার দপ্তরেই আলাপ হলো। রংপুরের সন্তান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। রেড ক্রিসেন্টের জীবন সদস্য। নিমোর সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা করলেন। আমি অভ্যাগত- কেবল শুনছিলাম। মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম কঠিন শিলা প্রকল্পের ইতিবৃত্তি। একপর্যায়ে তিনি আমাদের সাথে বের হলেন প্রকল্প এলাকা ঘুরিয়ে দেখাতে।
সংক্ষেপে জেনে নেই এই পকল্পের কিছু কথা।
১৯৭৪-৭৫ সালে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়া ও সংলগ্ন এলাকায় ছয়টি কূপ খনন করে এবং ভূ-পৃষ্ঠের অতি অল্প গভীরতায় পুরাজীবীয় যুগের কেলাসিত ভিত্তিস্তরে কঠিন শিলার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এ সকল কূপে ভূ-পৃষ্ঠের ১২৮ মিটার থেকে ১৫৪ মিটার গভীরতায় পুরাজীবীয় কঠিন শিলা পাওয় যায়। বাংলাদেশ সরকার মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনন ও উত্তোলন প্রকল্পের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করার লক্ষ্যে এসএনসি নামক কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করে। ১৯৭৭ সালে সমীক্ষা শেষে এসএনসি প্রকল্প কারিগরি এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে নিরাপদ এবং লাভজনক হবে বলে মত প্রকাশ করে। ১৯৭৮ সালে সরকার কঠিন শিলা উৎপাদনের লক্ষ্যে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি প্রকল্প অনুমোদন করে অর্থায়নের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার উত্তর কোরিয়া সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পেট্রোবাংলা এবং উত্তর কোরিয়া সরকারের পক্ষে ন্যাম ন্যাম নামক কোম্পানি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ১৯৯৪ সালের প্রথমদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়।
মধ্যপাড়া ভূগর্ভস্থ কঠিন শিলা প্রকল্প প্রায় ১.৪৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। কঠিন শিলা খনন করা হয় রুম অ্যান্ড পিলার এবং সাব লেভেল স্টোপিং পদ্ধতিতে। খনি স্থাপনের জন্য ২৪০ মিটার ব্যবধানে পাঁচ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট দুটি খাড়া সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করা হয়। একটি সুড়ঙ্গ পথ মালামাল, যন্ত্রপাতি ও শ্রমিক পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত হয়, যার গভীরতা ২৪৩ মিটার এবং অপর সুড়ঙ্গ পথটি ব্যবহৃত হয় কঠিন শিলা পরিবহণে যার গভীরতা ২৮৭ মিটার। কেলাসিত ভিত্তিস্তরের উপর ১০০ মিটার থেকে ১৩০ মিটার পুরুত্বের ডুপি টিলা স্তরসমষ্টি অবস্থান করায় এর মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ বা শ্যাফট নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যয়সাপেক্ষ বিশেষ পদ্ধতি তথা বরফীকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। ভূ-পৃষ্ঠের নিচে ১৭০ মিটার থেকে ২৩০ মিটার গভীরতা থেকে কঠিন শিলা আহরণ করা হয়। মধ্যপাড়া কঠিন শিলার প্রাক্কলিত মজুতের পরিমাণ ১৭২ মিলিয়ন টন এবং উত্তোলনযোগ্য মজুত প্রায় ৭২ মিলিয়ন টন। মধ্যপাড়ার এইসব কঠিন শিলা মূলত নাইস, গ্রানোডায়োরাইট এবং কোয়ার্টজ ডায়োরাইটসহযোগে সৃষ্ট।
উত্তর কোরীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ন্যামন্যাম মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও পাথর উৎপাদনে আশানুরুপ গতি আনতে না পারায় তার পরিবর্তে বেলারুশের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জার্মানীয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামকে খনির উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। এজন্য ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির সাথে ১,৪০০ কোটি টাকা মূল্যে ৬ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী কোরীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের রেখে যাওয়া যন্ত্রপাতি দিয়ে তারা নতুন উদ্যোমে পাথর উত্তোলন শুরু করে। প্রথম দিকে তারা এক শিফটে, পরবর্তীতে দুই শিফটে ও সবশেষে তিন শিফটে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার মেট্রিকটন পাথর উত্তোলন করতে থাকে। সময়মত নতুন যন্ত্রপাতি আনতে না পারায় খনির পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর দায়ভার নিয়ে খনি কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলছে রশি টানাটানি।
প্রচন্ড রোদ, রাফিজুল ইসলাম আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। অনেক যন্ত্র অব্যবহৃত অবস্থায় দেখতে পেলাম। নতুন কিছু যন্ত্রও দেখা গেল। হয়তো বা শীঘ্রই প্রকল্পে পাথর উত্তোলন শুরু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করলেন।
এর ফাঁকে আরেকটা কথা বলে রাখা ভাল। আমার ঢাকা ফেরার নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর ১২টা। ডা. নিমোর এই অভিযানের ফলে ১২টা বাস ধরা যাবে বলে সন্দেহ দেখা দিল। কথাটা তাকে জানাতে আমার টিকেটের ডিটেইলস নিয়ে ফোন তুললেন। আমার টিকেট ছিলো এস আর পরিবহনে। নিমো সেখানে ফোন করে আমার টিকেট বাতিল করতে এবং অন্য কোন পরিবহনে ৩টা বা তার পরে টিকেট কাটার জন্য নির্দশনা দিলো। ১৫-২০ মিনিট পরে জানা গেল, বিকাল ৩টায় অন্য এক পরিবহনে আমার টিকেট কনফার্ম করা হয়ে গেছে। জানতে পারলাম, এস আর পরিবহন-এর মালিক তার এক ভগ্নিপতি।
রাফিজুল ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং জলিল সরকারকে সাধে নিয়ে প্রকল্প এলাকা থেকে বের হয়ে এলাম। জলিল সাহেব গেটে নেমে গেলেন, তার অন্য কোনো প্রোগ্রাম রয়েছে। আমরা ফিরে চললাম রংপুরের পথে।
ফিরতি পথে ঢাকা মহাসড়কের কোন একস্থানে গাড়ী থেমে গেল। ছোটখাটো এক রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হলো। জানা গেল নিমো এখানে প্রায়শই যাতায়াত করে থাকে। পথনির্ভর ভ্রমণকারীর জন্য এর থেকে ভাল গন্তব্য আর কি হতে পারে?
গরমে ঘেমে ভিজে-নেয়ে একাকার হয়ে হন্তদন্ত হয়ে শহরের দিকে ফেরার প্রস্তুতি। সময় বয়ে চলেছে- ঢাকাগামী বাস ধরতে হবে। চালকের আসনে আগের মতই নাইমা নিমো। পেছনের আসনে বসে দু’চারটা কথা হলো। কাব্যলোকের পরবর্থী আয়োজন গ্রীষ্মের কবিতায় তার কবিতা দেবার কথা আদায় করা হলো। অনুরোধ রইলো কালেবশেখীর মতো ছুটে বেড়ানোর পাশাপাশি স্বীয় পেশায় কিছুটা হলেও সময় দেবার। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটি আর কোন কথা দিলেন না।
মিটিট পাঁচেক আগেই আমরা পৌঁছে যাই বাসস্ট্যান্ডে- যদিবা এজন্য তাকে কিছুটা বেশী পথ অতিক্রম করতে হয়েছে যানজট এড়ানোর জন্য। সঙ্গত কারণে গাড়ী ছুটেঠে তীব্র গতিতে- চালক যখন বলিষ্ঠ, তখন ভীতির কারণ থাকতে পারে না। তবু সতর্কতা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ, এটা মানতেই হবে।
নিমো আর শাকিলের বিদায়ে পালা- শেষ কথা: জীবনশূখী হতে হবে, নইলে রসুলপুরের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানান নিমো। এরপর খানিকটা অপেক্ষার পালা- বাস ছাড়ার জন্য।
তপ্ত দুপুরে কালো পিচঢালা পথ ধরে এগিয়ে চলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ী; আসনটাকে সামান্য পেছনে হেলিয়ে আরামদায়ক অবস্থান নেয়ার প্রচেষ্টা…. মগেজ তখন গত দুদিনের চিত্রগুলো চলমান হয়ে ওঠে তৃতীয় নয়নে যা দেখা দেয় ক্রমাগত।
না, ফিরতি ভ্রমণটা আরামদায়ক হয় নি মোটেও। ঢাকায় ফিরেছি মধ্যরাতের পরে- কল্যাণপুরে পা রাখার সময় ঘড়িতে সময় রাত দুটো অতিক্রম করেছে।