ভ্রমণ

পুরানখ্যাত করতোয়া তীরে- দ্বিতীয় পর্ব

নুরুল্লাহ মাসুম

সন্ধ্যায় রংপুরের উদ্দেশে যাত্রা। সরাসরি রফিক হাসনাইনের বাসায়। ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে। হাসানাইন গিন্নী আমাদেরই অপেক্ষায় ছিলেন। সান্ধ্যকালীন আপ্যায়নে বিলম্ব হলো না। প্রথম দেখা তাঁর সাথে। অতি সহজেই আপন করে নিলেন। হাসনাইন ভাইয়ের দুটি মেয়ে। বড়টির সাথে আগে কথা হয়েছে। ওর লেখা শারদীয়া অনলাইন ও প্রিন্ট ভার্সনে ছাপা হয়েছে। ভালই লেখার হাত অনিন্দিতার। ফ্রেস হয়ে এবং ভাবীর আপ্যায়ন শেষে রংপুর নগরী দেখতে বের হলাম, এসই সাথে আগামীকালের বাস টিকেট কেনার উদ্দেশ্যও ছিলো।
প্রথমেই বাসের টিকেট সংগ্রহ করা হলো। এবার নিশ্চন্ত হয়ে শহর ঘুরে দেখা। যন্ত্রচালিত রিক্সা নেয়া হলো। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো চেনাতে লাগলেন হাসনাইন ভাই। স্বভাবসূভ ভঙ্গিতে বর্ণনা করে যাচ্ছেন তিনি। আমিও শুনছি। রংপুরে এসে কারমাইকেল কলেজ দেখা হবে না, এটা কেমন করে হয়। চলো- যেই কথা, সেই কাজ। আলো-আধারীতে রিক্সায় কারমাইকেল কলেজ দর্শন। তারপরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্চ আমার শিক্ষক। তাঁকে ফোন দিলাম। কথা হলো, কিন্তু ব্যস্ত থাকায় দেখা করার সময় দিতে পারলেন না। পরদিন সকালে দেখা করার কথা বললেন। আমার সময় না হওয়ায় তাঁর মতো গুনী ব্যক্তির সাথে এদফা দেখা হলো না।
রাত বাড়ছে, সাথে ভ্রমণের আনন্দটাও বাড়ছে। নগরীর রাস্তা ফাঁকা হতে শুরু করেছে। রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ী শহর থেক তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দূরত্ব দু’জন স্কাউট নেতার কাছে কোনো বিষয় নয়। তাছাড়া ওই দিকটায় গেলে দেখা মিলতে পারে পেয়ারা ভাইয়ের সাথে। তাই রিক্সা বদল করে ছুটে চরা তাজহাট জমিদার বাড়ীর দিকে।
ইতাহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রাসাদটি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় নির্মাণ করেছিলেন। এও জানা যায় মহারাজা গোপাল রায় পেশায় ছিলেন একজন স্বর্ণকার। কথিত আছে, তার মনমুগ্ধকর তাজ বা মুকুটের কারণেই এ এলাকা তাজহাট নামে অভিহিত হয়ে আসছে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রাসাদটি ব্যবহৃত হয় রংপুর হাইকোর্ট বেঞ্চ হিসেবে। ১৯৯৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রাসাদটিকে একটি সংরক্ষিত স্থাপনা তথা স্থাপত্য হিসেবে ঘোষণা করে। এ স্থাপস্ত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবনে করে ২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘরকে সরিয়ে এ প্রসাদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে আসে। রাতের বেলা জমিদার বাড়ীর ভেতরে যাবার সুযোগ নেই, অগত্যা প্রথম দর্শনে তাজহাট জমিদার বাড়ীর বহিরাঙ্গণ দর্শনই হলো আমার প্রাপ্তি। জমিদার বাড়িটি এখন একটি জাদুঘর।
অন্ধকার হাতরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম পেয়ারা বাইয়ের বাড়ির দিকে। পেয়ারা বাইয়ের পুরো নাম আনিসুল হক পেয়ারা, রংপুরের একজন আদর্ম শিক্ষক এবং স্কাউট লিডার। স্কাউটিং-এর সুবাদেই তাঁর সাথে পরিচয় ১৯৮০ সালে- মৌচাক স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, পঞ্চম এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্কাউট জাম্বুরীতে। সেই থেকে ২০০০ সাল অব্দি যোগাযোগ ছিল। প্রায় দেড় যুগ ব্যবধানে যখন তার সামনে হাজির হরাম, তিনি কোনো কিছুই মনে করতে পারলেন না; অথবা মনে করতে চাইলেন না। পেয়ারা বাই খুব রসিক মানুষ ছিলেন, অন্তত আমি যতটুকু জেনেছি। রংপুরে স্কাউটিং বলতে একসময় পেয়ার ভাইকেই বোঝাতো। দীর্ঘ দিন রংপুর জেলা স্কাউটস-এর কমিশনার ছিলেন। আমার ভ্রমণসঙ্গী রফিক হাসনাইন পেয়ারা ভাইয়ের উত্তরসূরী হয়েছিলেন। স্বল্প সময়ের সাক্ষাৎ শেষে ফিরে চললাম। পেয়ারা ভাইয়ের স্মৃতি শক্তি লোপ পাওয়ায় খানিকটা খারাপ লাগলো বই কি!
শহরে ফিরে এসে দেখা হলো রংপুরের অতিপরিচিতজন রজনীতিবিদ মোজাফ্ফর হোসেন-এর সাথে। তিনি রংপুর মহানগর বিএনপি’র সভাপতি। আগে জেলা বিএনপি’র সভাপতি ছিলেন। রফিক হাসনাইন আওয়ামী লীগের দুর্দান্ত কর্মী। আওয়ামী আইনজীবীদের নেতাও বটে। তবু প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতার সাথে তার চমৎকার সম্পর্ক ও হৃদ্যতা আমায় মুগ্ধ করেছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমনটাই তো হওয়া উচিত- অথচ সর্বত্র এটা অনুপস্থিত; যা গণতন্ত্র বিকাশের মূল অন্তরায়। মোজাফ্ফর ভাই আপ্যায়িক করলেন একটা সম্ভ্রান্ত রেস্তোরাঁয়। অনেকক্ষণ আলাপচারিতা। রাজনীতি, অর্থনীতি- অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে রাত গভীর হয়ে গেল। অবশেষে বিদায় নেয়ার সময় তিনি বললেন, আবার রংপুর বেড়াতে এলে তার আতিথেয়তা গ্রহণ করি যেন। তার সাথে আলোচনা পর্ব মনে রাখার মতোই বটে।

করতোয়ার উপর সেতুতে লেখক

১২ এপ্রিল। হাসনাইন ভাইয়ের স্ত্রী- ভাবী সকাল সকাল আমার জন্য খাবার তৈরী করলেন। উকিল সাহেবকে আদালতে যেতে হবে। একসাথে আহার পর্ব শেষ করে, ভাবী ও বাচ্চাদের বিদায় জানালাম।
এরপরের গল্পকথা অন্য বিষয়ে। এবারে ভিজুয়ালাইজ হবেন শাকিল ও নিমো। সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে সাক্ষাৎ মিললো তাদের। শাকিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্র। আর নিমো হচ্ছেন একজন চিকিৎসক, পুরো নাম নাইমা খালেক। পেশায় চিকিৎসক হলেও প্র্যাকটিস করেন না বা কোনো চাকুরী করেন না। রংপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনে অতি পরিচিত নাম; সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন সংস্কৃতি ও সমাজ সেবা নিয়ে। তার সাথে কথা হয়েছিল আজ পুরাণখ্যাত পূণ্যতোয়া করতোয়া নদ দেখাতে নিয়ে যাবেন। যেই কথা সেই কাজ। নিজে গাড়ী চালান। চালক হিসেবে খুবই দূর্দান্ত তিনি। গান গাইতে পারেন বেশ। তবে দুঃখের গান শোনেন বেশী। তবে কি তার জীবনটা দুঃখে ভরা!
রংপুরের রসুলপুর- এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চল, একসময়ের নামকরা জমিদারী। সেই জমিদার বাড়ির সন্তান ডা. নাইমা খালেক। নিজেকে নিমো নামে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দবোধ করেন।

ফাইন্ডিং নিমো নামে একটি মুভি রয়েছ- ওয়াল্ট ডিজনি প্রযোজিত; যা অ্যানিমেশন স্টুডিওতে নির্মিত একটি কম্পিউটার এ্যানিমেটেড কমেডি, ড্রামা ও অ্যাডভেঞ্চারধর্মী চলচ্চিত্র। ২০০৩ সালে মুক্তি পায়। এর পুরো কাহিনী আবর্তিত হয় নিমো নামের একটি ছোট্ট কৌতূহলপ্রবণ শিশু ক্লাউনফিশকে ঘিরে, যার অতিরক্ষণশীল বাবা মার্লিন, ডোরি নামের একটি নীল সার্জনফিশকে সাথে নিয়ে তার অপহৃত পুত্রসন্তানকে সিডনি বন্দরের পথে খুঁজে বেড়ায়। এর মাঝেই মার্লিন তার সন্তানের ঝুঁকিকে সহজভাবে নিতে শেখে এবং নিমোকে নিজের খেয়াল রাখতে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়। ছবিটি ২০১২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর থ্রিডি ফরমেটে দ্বিতীয়বার মুক্তি পায় এবং ৪ ডিসেম্বর ডিভিডিতে বাজারে আসে। সমালোচকদের কাছ থেকে ব্যাপকভাবে প্রশংসা পাওয়া এ ছবিটি একাডেমী এওয়ার্ডে সেরা অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র বিভাগে পুরষ্কার এবং বেস্ট স্ক্রিনিং বিভাগেও মনোনীত হয়। ২০০৩ সালে সর্বোচ্চ আয় করা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে এটির অবস্থান দ্বিতীয়। এছাড়াও সর্বকালের সবচেয়ে বেশি ডিভিডি কপি বিক্রির গৌরবও এই ছবিটির অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে।
তবে কি আলোচ্য ডা. নাইমা নিজেকে ফাইন্ডিং নিমো’র নিমোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়!
নাইমার পিতা শাহ আব্দুল খালেকো ছিলেন সমাজসেবী। তিনি রেড ক্রিসেন্টের জীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়া রংপুর চেম্বারসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন। নাইমার দাদা খন্দকার শাহ আব্দুর রউফ ছিলেন আইন এপশায় যুক্ত এবং রংপুরের পিপি ছিলেন। তাঁর বাবা শাহ কলিম উদ্দিনও আইনজীবী ছিলেন। নাইমার মা নিলুফার খালেক রংপুর রেড ক্রিসেন্ট, লেডিস ক্লাব রংপুর অটিস্টিক ফাউন্ডেশনসহ বহু সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। তাঁর বাবা এমদাদ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ)। তাঁর বাবা (নাইমার মায়ের দাদা) খান বন্দে আলী মিয়া ছিলেন রসুলপুরের জমিদার।
নাইমাকে নিয়ে এত কথা বলার কারণ, প্রথম দর্শনেই তাঁর ভেতরে একটা আভিজাত্যের ছাপ লক্ষ্য করেছিলাম- চলনে এবং বলনে। আগেই বলেছি, চালক হিসেবে তিনি দূর্দান্ত প্রকৃতির। ভাল গাইতেও পারেন। সংস্কৃতিসেবী হওয়ায় তার পরিচয়র পরিধি বেশ। কবিতাও লেখেন- ভাল আবৃত্তি করেন। তার কবিতায় কষ্টের ছোঁয়া একটু বেশী বলেই মনে হলো।

আরও দেখুন

এ বিষয়ের আরও সংবাদ

Close