প্রবন্ধ
সেলমা লেগারলফের কথাশিল্পে বিশ্বজয়
মোমিন মেহেদী
স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলা স্বপ্ন নতুন কথা বলা
এসব নিয়েই হাসি
সেলমা যেমন লিখে গেছেন জীবন থেকে শিখে গেছেন
লেখা ভালোবাসি…
প্রথম নারী নোবেল জয়ী সেলমা লেগারলফের সংগ্রামী জীবন নিয়ে এমন অনেক কিছুই লেখা যায়। অনেক বলা যায় তার অনবদ্যতার কথা। তিনি নিবেদিত লেখক হিসেবে ব্যাপক আলোচিত ছিলেন। সেই আলোচনাই তাকে আজো জীবন্ত করে রেখেছে। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম নারী লেখক সেলমা লেগারলফের সাহিত্য সাধনায় অগ্রসর হয়েছেন নিরন্তর। আর তার সূত্র ধরে এটুকু বলা যায় যে, সুইডিশ এ লেখক প্রচন্ড একাগ্রতা আর মনোশক্তি দিয়ে জয় করেছেন শারীরিক পঙ্গুত্ব। তার সংগ্রামী জীবনকথা তিনি নিজের মত করে সাজিয়ে সাজিয়ে লিখেছেন নির্মলতার রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে। তার শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্য ‘নিলস হোলগার সন্স আন্ডারবারা রেসা জেনম সভারিজ’ বা ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চার্স অব নিলস’-এর জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। বাস্তববাদিতার বিপরীতে কল্পনা ও আধ্যাত্মিকতাই সেলমা লেগারলফের সাহিত্যের প্রধান অনুষঙ্গ। তার অধিকাংশ বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ইনভিজিবল লিঙ্কস, দ্য মিরাকলস অব অ্যান্টিক্রাইস্ট, জেরুজালেম, দ্য ট্রেজার, দাই সোল সেল বেয়ার উইটনেস, দ্য ফ্যান্টম ক্যারিজ, গোস্তা বার্লিংস সাগা, ওসলিঙ্গা ল্যাঙ্কার, ডকটিটারস্পেল, দ্য আউটকাস্ট, মারবাকা : দ্য স্টোরি অব এ মেনর, মেমরি অব মাই চাইল্ডহুড : ফার্দার ইয়ার্স অ্যাট মারবাকা এবং হার্ভেস্ট। এ ছাড়া তার আরও অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি বইতে তিনি নিজের জীবন থেকে পওয়া স্বপ্নজ জীবনের কথা তুলে এনেছেন নিবেদিত থেকে। তিনি যে শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ ছিলেন, তা কখনোই তার লেখায় আসেনি; আসেনি জীবনের কোন আক্ষেপও।
অবশ্য সেই জীবনজুড়ে রাতজাগা স্বপ্নকথার রাস্তা। যে কারনে তিনি মারকাবার বাড়ি ফিরে পাওয়ার মত অনন্য কাজটি সম্ভব করেছিলেন। যে কাহিনীর সূত্রতায় জানা যায়, ১৯০৭ সালে সেলমা জানতে পারেন কোনো এক দুঃসময়ে বিক্রি হওয়া তাদের মারকাবার বাড়ি আবার বিক্রি হচ্ছে। তিনি দেরি না করে সেই বাড়িটি কিনে নেন এবং যাবতীয় পরিচর্যা করে সেটিকে নতুন রূপ দেন। এমনকি তিনি ওই বাড়ির চারপাশের অনেক জমিও কিনে ফেলেন। আর এরই মধ্য দিয়ে অবারিত সুখের রাস্তায় অগ্রসর হোন তিনি। তার জীবনজুড়ে এমন অনবদ্যতা ছিলো যে, তিনি নির্বাক চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তার লেখা উপন্যাসকে কেন্দ্র করে ১৯১৭ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে কয়েকটি নির্বাক চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজ। ১৯২৭ সালে গোস্তা বার্লিং সাগা উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল- যার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন গ্রেটা গারবো। আর এই চলচ্চিত্র তাকে করে তুলেছিলো সেই সময় থেকে আজ অবধি জীবন্ত আর প্রাণবন্ত। মৃত্যুর শত বছর পরও তিনি নিজের কর্মগুণে স্মরণিয় ও বরণিয় হয়েছেন।
আর এই বরণিয় অবস্থান নির্মাণের লক্ষ্যে সেলমা লেগারলফ ১৮৫৮ সালের ২০ নভেম্বর মারবাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এরিক গুস্তাফ লেগারলফ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (লেফটেন্যান্ট) ছিলেন। মায়ের নাম লুইস লেগারলফ নি ওয়ালরথ। এই দম্পতির ছয় সন্দানের পঞ্চম হলেন সেলমা। মাত্র তিন বছর বয়সে সেলমা পক্ষাাঘাতের কারণে পঙ্গু হয়ে যান। তিনি কোমরে আঘাত নিয়ে জম্মগ্রহণ করেন। কম বয়সে অসুস্থতায় তার দুই পা খোঁড়া হয়ে যায়। এ সময়ে তার দাদা তাকে প্রচুর ভূতপ্রেত আর রহস্যগল্প শোনাতেন। ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন বয়সের তুলনায় ভারিক্কি ও শান্ত স্বভাবের। তবে তার মদ্যপ বাবা চাননি সেলমা পড়াশোনায় মনোযোগ দিক। কিংবা তিনি এটাও চাননি- সেলমা নারী আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করুক। ১৮৮৪ সালে বাবার অসুস্থতার কারণে মারবাকা এস্টেট বিক্রি করতে বাধ্য হন, যা তার জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শিক্ষা জীবনে সেলমা ছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী। তার প্রতিভা দেখে সেই সময়ের সেরা লেখক আনা ফ্রিসেল তাকে পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব নেন। প্রিপারেটরি স্কুল শেষ করার এক বছর পর তিনি স্টকহোম টিচার ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন এবং তিন বছর পর ১৮৮৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্কুলে থাকাকালীন তিনি হেনরি স্পেনসার, থিওডোর পার্কার ও চার্লস ডারউইনের মতো উনিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের লেখা পড়ে শেষ করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি সেলমা ছিলেন নিবেদিত তার লেখনিতেও। ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি প্রচুর কবিতা লিখতেন। ১৮৮৫-৯৫ সাল পর্যন্ত ল্যান্ডস্ক্রোনার একটি বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এ সময় তিনি গল্প বলার কৌশলের ওপর জোর দেন। তিনি তার প্রথম উপন্যাস গোস্তা বার্লিংস সাগা এ সময়েই লিখতে শুরু করেছিলেন, যা পরে ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয়। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রচন্ড নেশা ছিল তার। স্টকহোমের রয়েল উইমেন্স সুপিরিয়র ট্রেনিং একাডেমিতে থাকাকালীন তিনি অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের মতো সমসাময়িক লেখকদের বাস্তববাদিতার বিরোধিতা করেন। ১৮৯৫ সালে লেখালেখিতে মনোযোগ দেয়ার উদ্দেশে শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। স্টকহোমের রয়েল উইমেন্স সুপিরিয়র ট্রেনিং একাডেমিতে পড়াকালে সুইডিশ সাহিত্যে প্রচলিত বাস্তববাদের বিরোধিতা করেন। এসময় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘গস্তা বেরলিংস সাগা’লেখা শুরু করেন। এর প্রথম অধ্যায় একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতায় জমা দিয়ে বইটি প্রকাশের পুরস্কার জিতে নেন। এছাড়া লেখালেখির জন্য বিখ্যাত সুইডিশ নারীবাদী ফ্রেদারিকা লিমনেলের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন। তিনি তখনকার দিনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইউরোপিয়ান লেখকের সান্নিধ্য পান। ১৯০০ সাল থেকে সেলমা ইতালি, ফিলিস্তিনসহ প্রাচ্যের অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন। এসব অভিজ্ঞতা তার লেখনীতে ফুটে উঠেছে। তিনি ১৯০৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পান।
অবশ্য এরও অনেক আগে ১৮৯৪ সালে স্বদেশী নারী লেখক সোফি এলকানের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারা একসঙ্গে থেকে সাহিত্যকর্মে মনোনিবেশ করেন। এ সময়ে তারা একে অন্যের লেখার গঠনমূলক সমালোচনাও করেন। যদিও তারা পরস্পর গভীর ভালোবাসায় আবদ্ধ ছিলেন। সম্পর্কের এক পর্যায়ে এলকান সেলমার রচিত সাহিত্যের সাফল্যে ঈর্ষান্বিতও হন। তিনি প্রচন্ডভাবে ভালোবাসতেন শিশুদেরকে। যে কারনে তিনি নিজের অধিকাংশ লেখাতেই তুলে এনেছেন শিশু আর কিশোরদের কথা। তিনি এতটাই সুহৃদয়বান ছিলেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সেলমা নোবেল পুরস্কার ও গোল্ড মেডেল ফিনল্যান্ডকে দিয়ে দেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আর্থিক তহবিল সংগ্রহ করার জন্য। পরে ফিনিশ সরকার অন্যভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করে তার মেডেল তাকে ফেরত দেয়। অন্যান্য পুরস্কারসহ তিনি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানজনক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এতটাই নিজেকে নিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি আর সততায় এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে জীবন বোধের কথায় লিখেছেন, ‘যে তোমাকে ভালোবেসেছে, পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়ে তার ঋণ তুমি শোধ করতে পারবে না।’ ‘কোনো ভ্রমণে গেলে তুমি এই ভেবে বিস্মিত হবে যে- তুমি বাড়ি ফিরে এসেছ।’ শুধু এখানেই শেষ নয়; অনন্য জীবনের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যেতে যেতে তিনি লিখেছেন, ‘তুমি কি কখনও কোনো শিশুকে তার মায়ের হাঁটুর ওপর বসে পরীর গল্প শুনতে দেখেছ? একসময় শিশুটি যখন শোনে সুন্দরী রাজকন্যা হিংস্র দৈত্যের সামনে বিপদাপন্ন অবস্থায় রয়েছে- তখন শিশুটি চোখ বড় করে মাথা ওপরের দিকে উঁচিয়ে তাকিয়ে থাকে। যখন তার মা তাকে সূর্যালোক আর কোনো সুখের গল্প শোনায় তখন সে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। …আমিও তার মতোই শিশু।’ মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, অনলাইন প্রেস ইউনিটি