গল্প
চলমান

মন যেনো আজ প্রজাপতি

নূরহাসনা লতিফ

কারখানায় যাওয়ার সময় মুকিত ওকে দেখতো, বাবার পাশে বসে আছে। ওর নাম বাহানা। বাবা কাঠের কাজ করে। তবে রাসেদ পেশাদার লোক নয়।জমির কাজ করে যে সময় পায় সেটাই কাজে লাগায়।পরিচিত জনেরা এটা ওটা বানাতে দেয়। সেগুলো সে অবসরে বানায়।স্বল্প আলোতে কাজ চলতে থাকে ঠুক ঠুক করে।ওর পনেরো বছরের মেয়ে বাহানা কখনো পাশে বসে থাকে। কখনো সে নিজেই কাজ করে।কাঁথা বানায়, শিকে বানায়,আবার লুডুও খেলে ওর বান্ধবীর সাথে।এই মেয়েটাই ঘরের সমস্ত কাজ সারে।ওর মা মরে যাওয়ার দুই বছর হলো। ডুরেকাটা শাড়ি পরে সে পেঁচিয়ে ।পাতলা গড়ন।মেঘের মত ঘন একরাশ চুল হাটু পর্যন্ত ।টিকালো নাক। গভীর কালো দুটো চোখ।মুখের নকশায় আছে আকর্ষণ।গায়ের রংটা মাজা । তার পরেও সুন্দরে কমতি নেই। মুকিতের যেনো নেশার মত হয়ে গেছে।একদিন ওকে না দেখলে ভাল লাগেনা।ছু্টির দিনেও বিনা কারণে বাজারে যায় ওকে দেখার ছলে।মেয়েদের যে একটা আকর্ষণ আছে এখন সে সেটা বোঝে । সেদিন কারখানা থেকে ফেরার সময় দেখলো একগাদা চাল নিয়ে বসেছে বাহানা।ধান ভাংগানো হয়েছে বাড়িতে আসা ভ্রাম্যমান মেশিন দিয়ে। মা নেই বলে অনেক কাজ করতে হয় একা।বাবা বলেন, একটা লোক নিতে পারিসনা এত্ত এত্ত কাজ ক্যামনে করস। লোকতো পাওন যায়না বাবা।সব মাইয়ারা গ্যাছে ঢাকা শহরে গার্মেন্টসে কাম করতে।কথাটা একদম ঠিক।কাজের জন্য এখন ঢাকায় চলে যায় সব।বাবা কাছে এসে বলেন এখনতরি খাওয়া হয় নাই ।গোসল হয় নাই।এখন ওঠ।গোসল সাইরা খাইয়া লও।সেদিন ছিলো ছুটির দিন।ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছে মুকিত ।কাপড় জামা ধোয়া হয়নি অনেক দিন। একা বাড়িতে আর ভাল লাগেনা।ওরা ছিলো চর এলাকার মানুষ।অনেক বছর আগে এ গ্রামে এসেছিল কাজ নিয়ে। মা বাবা দুজনের ভাল লেগে যায়।বাবা বলেন ,জরিণা আমরা এইখানে থাইকা যাই। তারপর বাড়ি বানিয়ে এখানেই থেকে যায়।বাবায় বিভিন্ন রকমের কাজ করতো। মুকিতকে ভর্তি করে দেয় গ্রামের স্কুলে। মাও বসে থাকতোনা ঘরের আশে পাশে সবজি বুনতো। সুন্দর একটা সংসার।এখানে আত্মীয় স্বজন না থাকলেও আপন করে পেয়ে ছিলো গ্রামের লোকদের। মুকিতের মা জরিণা ভালো কোরান পড়া জানতো।আর তাই অনেক বাড়িতেই বউ ঝিদের কোরান শরীফ পড়া শেখাতো। বাবা বলতো ,মুকিত তোরে বাবা লেখা পড়া শেখাবো।পড়াশুনা করে তোকে চাকরি করতে দেবো। মাঝে মাঝে চর এলাকায় নানা বাড়িতে যেত বেড়াতে। সেই দিনগুলি কি আনন্দের না ছিলো। বাবা মা বেশ কিছু জমি জমাও করে এখানে।বাবা বলতেন এই জায়গাটা আমাগো ভালোবেসেছে তাই তো থাকতে পারতাছি।উনি খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারতেন।আর তাই দাওয়ায় বসে রাতে বাঁশি বাজাতেন। গ্রামের অনেকেই আসতেন।পান তামাক খেয়ে বাঁশি শুনতেন অনেক রাত পর্যন্ত। জোছনার আলো গলে গলে পড়তো। সে ছিলো কি চমৎকার সময়।বাড়িতে কিছু বর্ষার ফুল লাগিয়ে ছিল মা।সাদা ফুলের সৌরভে ভরে যেত বাড়িটা। ফুলের গাছগুলো আজও আছে।বাতাসে সুগন্ধ ছড়ালে মুকিতের মনে হয় সে যেনো মায়ের ভালোবাসা। মা বাবা একদিনেই হারিয়ে গেল ওকে ছেড়ে। কে জানতো বন্যা ওর এত বড় সর্বনাশ করবে।বাড়িতে পানি উঠেছিলো।পানিতে কাজ করে দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়ে পানি বাহিত রোগ ডায়েরিয়ায়। দুজনেই মারা যায় একই দিনে।খবর পেয়ে মামা ওকে নিতে এসেছিলেন কিন্তু মুকিত যায়নি।বলেছে আমি কোথাও যাবনা বাবা মায়ের পছন্দের ভিটে ছেড়ে। গ্রামের লোকেরা ওকে সাহায্য করে।বিধবা ময়না ওর মায়ের বন্ধু ছিলো,সে বলে আমি তোরে রান্না কইরা দিব বাজান।তোর মায়েরে আল্লাহ নিছে আমি আছি ।আমি তরে দেখবো। আমারতো কেউ নাই।সেই থেকে ময়না খালা বেশির ভাগ সময় মুকিতকেই দেয়।মাতাব্বর সাহেব বলেন তুমি এস এসসি পাস করেছ চাকরির চেষ্টা কর।নদীর পাড়ে একটা সিরামিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে।ওখানে যাও ওরা বলেছে এই গ্রামের লোকদের নেবে ।চাকরিটা হয়ে গেল মুকিতের।সেই থেকে চাকরি করে মুকিত। ময়লা জামা কাপড়গুলো নিয়ে পুকুর পাড়ে এলো সে। ময়না খালা ওর অনেক কাজ করে দেয়।মাঝে মাঝে বলে,একটা বউ নিয়ে আয়।বউ আনতে গেলে কি করতে হয় ওর জানা নেই।বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। ওর জন্য কে করবে এসব? কাপড় ধুয়ে ফেরার পথে দেখা হয়ে গেলো বাহানার সাথে। সে যেনো কোথায় যাচ্ছে। শাড়ি পরেছে গোলাপি রংগের। হেসে হেসে কথা বলছে সঙ্গের মহিলার সাথে। বাড়িতে এলে ময়না খালা বলে ,রাতের বেলা আসতে পারমুনা।বাহানার আইজ বিয়া সেইখানে যামু । মুকিত বলে ,রাস্তার ধারে বাড়িটা।কাঠের কাম করে মানুষটা, তার মেয়ের কথা বলছো ?হ খুব ভালা মাইয়া।মুকিতের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।মাঝে মাঝে ওরও ইচ্ছে হোতো বাহানাকে বউ করার ।কোন দুষ্ট চক্র ওর ইচ্ছায় বাধা দিলো।ভালো করে খাওয়া হলোনা মুকিতের। মেয়েটা যেন ওর ভেতরে অনেকটুকু জায়গা দখল করে ফেলেছিলো।ওকে দেখলে বুকের ভেতরে বয়ে যেত একটা ঠাণ্ডা নদী। মা বাবা মারা যাওয়ার পর যেমন একটা কষ্ট পেয়েছিল তেমনি একটা কষ্ট কুণ্ডোলি পাকিয়ে ঊঠছে।এখন মনে হচ্ছে ভুল সে একটা করেছে । মাতাব্বর সাহেবের ছেলে সুজনের সাথে এ নিয়ে কথা বলতে পারতো। সুজন ওর বন্ধু। বাহানার বাড়িতে আজ অনেক আনন্দ ।আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভরে গেছে। বাহানার বিয়ে পাশের গাঁয়ের সলিমুদ্দির ছেলে আবিদের সাথে । বাজারে ওর বড় দোকান আছে। জমি জমাও আছে বেশ । বাড়ি ঘর ভাল।অনেকেই বলছে ,মেয়ের কপাল ভাল।বিয়ে হচ্ছে ভাল ঘরে ভাল বরে।সম্বন্ধ এনেছে বাহানার বড় ফুফা। অনেক রাতে বর যাত্রী এল।বরের বাবা বলে আমাদের আগে টাকাটা বুঝিয়ে দেন ।বাহানার বাবা বলে কিসের টাকা আমি বুঝবার পারলামনা। সলিম বলে, ছেলের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য৫০হাজার টাকা দেয়ার কথা আছিল।বাহানার ফুফা বলে,আমি টাকার কথা আগে বলি নাই ।মেয়েতো একটাই সবই হবে আপনাদের। ৫০ হাজার কেন এর চাইতে বেশি পাবেন ।ছেলের বাবা মানতে রাজি না, বিয়ের আসরেই নগদ টাকা চাই।এনিয়ে দুই পক্ষের অনেক বাক বিতণ্ডা হলো কিন্তু বিয়ে হলোনা।ছেলে নিয়ে চলে গেল বাবা। মাতাব্বর সাহেব এসেছিলেন বিয়েতে। ওনার চোখের সামনে ঘটে গেল পুরো ঘটনা ।উনি একটা কথাই বল্লেন,রাসেদ আর যাই করো যৌতুক দেবেনা। ওরা ফিরে গেলে মাথায় হাত দিয়ে বসে রাসেদ ।এখন কিহবে মাতবর সাহেব , ভেঙ্গে পড়ে সে কান্নায় । রাসেদ তুমি চিন্তা করনা আজ রাতেই তোমার মেয়ের বিয়ে দেব এর চেয়ে ভাল ঘরে ভাল বরে। অনেক রাতে মুকিতের ঘুম ভাঙ্গালে সুজন।মুকিত বলে কি হয়েছে সুজন?মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি একটা পাঞ্জাবী পরে আমার সাথে আয়।কেন কেউ মারা গেছে?সুজন হাসে। কেউ মারা যায়নি।তবে খুব সম্ভব তুই মারা যাবি ।ওর কথার কিচ্ছু বুঝতে পারেনা। কিন্তু সুজনের কাছে সে আত্মসমপর্ণ করে।এইটুকু বিশ্বাস বন্ধু তার কোন ক্ষতি করবেনা।বাহানাদের বাড়িতে যখন পৌঁছালো, সাজ গোজ সব ঠিক আছে বাড়ির কিন্তু প্রান নেই ।সুজন এবারে মুকিতকে বুঝিয়ে দিলে সব ।ওর কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়। ।মনে মনে আওড়ায় এও কি সম্ভব!সেই রাতে বাহানা আর মুকিতের বিয়ে হয়ে গেল।দুজনার যখন প্রথম দেখা হল একই কথার গুঞ্জরণ তুমি।অদৃশ্য রেকর্ডে বেজে ওঠে – মন যেন আজ প্রজাপতি।
আরও দেখুন

এ বিষয়ের আরও সংবাদ

Close