সাহিত্যাঙ্গন বাংলাদেশ ও অ্যাসোসিয়েশন ফর সাউথ এশিয়ান কালচার অ্যান্ড লিটারেচার এর আমন্ত্রণে হঠাৎ করেই ঢাকা থেকে বাইরে যাবার একটা সুযোগ এলো। ১০ থেকে ১২ এপ্রিল রংপুর জেলার পীরগঞ্জে অনুষ্ঠিত দক্ষিন এশিয়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য ১০ তারিখ গভীর রাতে যাত্রা শুরু- আরামদায়ক বাসে। এর আগে রংপুর একটিবার গিয়েছিলাম, ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে; সে অনেক আগের কথা বিগত শতকের নব্বইয়ের দশেকর কোনো এক সময়ে। পীরগঞ্জের খ্যাতি মূলত পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার কারণে। তাঁর এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় পৈত্রিক সূত্রে পীরগঞ্জের নাগরিক। জেনেছিলাম, আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপার ও ভুটান থেকে কবি-সাহিত্যিকগণ যোগ দেবেন; তাই আগ্রহটা একটু বেশীই ছিলো। পেশাগত কারণে সাধারণত সহজে ঢাকার বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠে না। দুই দিনের পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা ছাড়লাম।
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে পৌঁছে গেলাম বগুড়ার শেরপুরে। এরপর চোখ মুদে থাকার ফুসরৎ নেই। অবিরাম সবুজের মাঝ দিয়ে কালো পিচঢালা মহাসড়ক। মাঠে সবুজের সমারোহ- ধান আর ভুট্টার ক্ষেত দুচোখ জুড়িয়ে দিলো। চৈত্রের শেষে এসেও দেখলাম দিগন্তে কুয়াশার আস্তরণ। এটা আসে বলেই তো এটা উত্তরবঙ্গ।
রবির দেখা মিলতেই পৌঁছে গেলাম আমার গন্তব্যে- পীরগঞ্জ। বাসস্ট্যান্ডে নেমেই এককাপ গরম চায়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম- দোকানী জানতে চাইলো আমার আগমনের হেতু। বুঝলাম, এরা জানে এখানে একটা বড় কিছু হচ্ছে। তার কাছেই শুনলাম বিদেশী কয়েকজন অতিথি ইতোমেধ্য পৌঁছে গেছেন।
বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। এরই মধ্যে কথা হয়েছে আয়োজনের সভাপতি রুখসানা জামান শানুর সাথে। আমায় অভ্যর্থনা জানাতে এলেন আয়োজনের মূল ব্যক্তি অ্যাসোসিয়েশন ফর সাউথ এশিয়ান কালচার অ্যান্ড লিটারেচার-এর সাধাররণ সম্পাদক সুলতান আহমেদ সোনা। তিনি স্থানীয় ব্র্যাক রেস্ট হাউসে পৌঁছে দিয়ে আমাকে বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেলেন। কত কাজ তার। খানিকটা বিশ্রাম নেবার সুযোগ পেয়ে বিছানায় গড়িয়ে নিলাম।
বেলা ১১টা দিকে আয়োজনস্থেল নেয়ার জন্য স্থানীয় এক সংবাদকর্মীকে পাঠানো হলো। দুঃখিত, তার নামটা মনে রাখতে পারি নি। যন্ত্রচালিত রিক্সা যোগে পৌঁছে গেলাম আয়োজনস্থল বয়েন উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছে। রাস্তার দু’ধারে সারিবদ্ধ স্কুল ছাত্ররা, ফুল দিয়ে আগত অতিথিদের বরণ করে নিচ্ছে। আমি বোধকরি একটু বিলম্বে এলাম। তদুপরি সকলের সাথেই মিছিলে যোগ দিতে পেরেছি ভেবে ভাল লাগলো। প্রায় অর্ধ কিলোমিটার ধরে স্কুলের ছাত্র-ছাদ্রীদের পুষ্পবৃষ্টি অতিক্রম করে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানো গেল। স্কুল মাঠে বিশাল আকারের প্যান্ডেল। দর্শক সারিতে স্থান নেয়ার আগে কুশল বিনিময় হলো ঢাকা থেকে আগত ভাষা সৈনিক ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ, কবি মো. নূরুল হুদা ভাইয়ের সাথে। এখানেই দেখা মিললো আয়োজক কমিটির সভাপতি কবি রুখসানা শানুর সাথে। কথা হলো বয়েন উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুল হক খোকন-এর সাথে; আয়োজকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। অতিথিদের আগমনের স্বল্প সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হয়। যেহেতু এটা আন্তর্জাতিক আয়োজন, সঞ্চালনা করা হয় বাংলা ও ইংরেজী- দুই ভাষায়। শুরুতেই আগত অতিথিদের পুষ্পমাল্যে বরণ করে নেয়া হয় এবং সকলকে লাল-সবুজ উত্তরীয় পড়িয়ে দেয়া হয়। অনুষ্ঠানের ধারা বর্ণনা দেয়া আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়, তাই এবিষয়ে বেশী কিছু লিখছি না।
অনুষ্ঠানের মাঝে বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণে সমস্য দেখা দিলেও একে অপরের সাথে যোগাযোগের সুযোগটা বাড়ে। পরিচিত হই ভারত থেকে আগত কবিদের সাথে। এদের মধ্যে ছিলেন- ভারতের উত্তর দিনাজপুরের কবি, সম্পাদক ও সমাজকর্মী সুশান্ত নন্দী, ত্রিপুরার স্রোত সম্পাদক গোবিন্দ ধর, মেঘালয়ের কবি ফাল্গুনী চক্রবর্তী। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে যাদের আসার কতা ছিল, তারা ভিসা জটিলতার কারণে যথাসময়ে পৌঁছাতে পারেন নি বলে জেনেছি। অনুষ্ঠানে অতিথি-বরণ, বক্তব্য, আবৃত্তি, সম্মননা প্রদান ইত্যাকার কার্যক্রমের মধ্যে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা পরিবেশন করে সংগীত। সব মিলিয়ে সুন্দর একটা সময় কাটে সেথায়। দুপুরের পরে আহার পর্ব। এটা অবশ্য একসাথে হয়ে ওঠেনি। আহারের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন রংপুরের অন্যতম সরকারী আইনজীবী রফিক হাসনাইন। স্কাউটিং-এর সুবাদে তার সাথে অনেক আগেই পরিচিতি ও সখ্যতা। আমি পীরগঞ্জে যাবো, রংপুরে একটিবার যাবো না- এমনটি তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তাই আদালতে হাজিরা দিয়েই চলে আসেন পীরগঞ্জে, উদ্দেশ্য আমায় রংপুর নিয়ে যাওয়া। আয়োজকদের সাথে কথা বলে এবং অনুমতি নিয়ে সন্ধ্যায় রংপুর যাবার সিদ্ধান্ত নেয় হলো। এরই মধ্যে যোগাযোগ ঘটে রংপুরের প্রাক্তন জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুস সোবাহানের সাথে। তিনি বাসায় আপ্যায়ন না করে ছাড়বেন না; অগত্যা যেতেই হলো। বিকেলের সুন্দর একটা সময় কাটলো তার বাসায়। সেখানে বেশ খোলামেলা আলোচনা হলো ত্রিপুরার কবি ও সম্পাদক গোবিন্দ ধর ও অন্য একজন নবীন কবির সাথে (নামটা মনে না করতে পারায় দুঃখিত)। আলোচনা মূলত সাহিত্য নির্ভর এবং ওটাই হওয়ার কথা। বলে রাখা ভাল, ত্রিপুরার দুই কবি পীরগঞ্জ অবস্থানকালে আব্দুস সোবাহানের বাড়ীতেই অবস্থান করছিলেন। কথা ছিল সুশান্ত নন্দীর সাথে রাতে ব্র্যাক রেস্ট হাউসে আড্ডা হবে; আমি রংপুর চলে আসায় সেটি আর হলো না। পরে অবশ্য নন্দীর সাথে অনলাইনে কথা হয়েছে বেশ।