বাবা আসামে চাকরি করতেন। ডিব্রুগড়ের বেরি হোয়াইট মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাশ করে সেকেন্ড ব্যাটালিয়ন আসাম রাইফেলসের রেজিমেন্টাল মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নেয়ায় ব্রিটিশ সরকার পুরস্কার হিসাবে তাকে কনডেন্সড এমবিবিএস পড়ার জন্য নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু এটা কার্যকর হতে হতে দেশ ভাগ হয়ে গেছে, এসে গেছে ১৯৫২ সাল। তিনি আসাম সরকারের চাকরি ছেড়ে পূর্ব বঙ্গ সরকারের অধীনে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে যোগ দিয়েছেন। এক সরকারের চাকরি ছেড়ে আরেক সরকারের চাকরিতে যোগ দেয়ায় তার বেতন পাচ্ছেন না। চরম আর্থিক সংকট। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে সেটা তখন টগবগ করে ফুটছে। বাসায় এসে প্রতিদিন যা ঘটছে তা মায়ের সাথে শেয়ার করেন বাবা। একদিন কলেজ ছুটির অনেক আগেই উত্তেজিতভাবে ফেরত এলেন তিনি। মা বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন —
– কি ব্যাপার?
– গভর্নমেন্ট গুলী করেছে। অনেক লোক মারা গেছে।
গভর্নমেন্ট মানে কি বুঝলাম না। গুলি করলে তো মানুষ মরে যায়। নিশ্চয় দৈত্য জাতীয় আজব কেউ বা কোন দুষ্ট লোক। সে সময় আমার স্কুলে পড়ার নয় রাতে বিছানায় হিসু করার বয়স। যথাযথভাবে কথাও বলতে পারি না।
১৪৭ লালবাগ রোডে মাসিক ৪০ টাকায় দুই রুমের একটা পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন বাবা। ভিতরে ছোট একটা উঠান। উঠানের একদিকে টিনের চাল আর বাঁশের বেড়া দেয়া কমন রান্না ঘর। বেশ দূরে একটা কুয়া পায়খানা। আব্বা সেক্রেটারিয়েটের একজন কর্মচারী ফজলুর রহমান সাহেবের সাথে ২০টাকা দিয়ে ভাগাভাগি করে এক রুম নিয়ে থাকেন। রহমান সাহেবের সাথে তার ভাই কি শ্যালক এ রকম কেউ থাকেন। অল্প বয়সী তরুণ। কলেজে পড়েন। তখন আংকেল ডাকের প্রচলন হয় নি। আমি তাকে চাচা ডাকি।
১৯৫৬ সালে সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলা স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯সালে ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে মর্যাদা দেয়। কিন্তু সেই ১৯৫২ সালের পর থেকেই বাঙালি ২১শে ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস হিসাবে স্মরণ করতো। গুলি বর্ষণের পর থেকেই ঢাকা মেডিক্যাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দলবেঁধে মিছিল করতো প্ল্যাকার্ড হাতে। বুকে থাকতো কালো ব্যাজ। আমাদের বাসাটা রাস্তার একদম উপরে। দরজা খুললেই দেখতে পাই প্রবল ক্রোধে আকাশে হাত ছুঁড়ে ওরা ফুঁসছে –
– রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই
– রাজবন্দীদের মুক্তি চাই
– শহীদ স্মৃতি অমর হোক
কখনো বা দলবেঁধে ওরা গান গায় –
ভুলবোনা ,ভুলবোনা ,মোদের সে একুশে ফেব্রুয়ারী ……..
এই গানের মর্মবাণীতেই পরবর্তীতে রচিত হয়েছে সে বিখ্যাত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ,আমি কি ভুলিতে পারি?
প্রায়ই পথচারীদের কাছে তারা দু ‘আনা দামে কালো ব্যাজ বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহ করে। দু’আনার তখন বেশ মূল্য। একটা ফুটো পয়সা দিয়ে সে সময় এক খিলি দোক্তা দেয়া পান পাওয়া যায়, আব্বা বেকার তবু তিনি ছুটে যেয়ে ব্যাজ কিনে আনতেন। নিজে সরকারি চাকুরে তাই পড়তে পারতেন না। আমার জামায় সেঁটে দিতেন। বাংলা ভাষার প্রতি আমার মমত্ববোধ তখন থেকেই গড়ে উঠেছিলো।
দেশে ক্রমাগত নিপীড়ন ও প্রতিবাদ চলছে। একদিন পড়ন্ত বিকেলে সেই চাচা আমাকে নিয়ে হেটে বেড়াতে বের হলেন। সে সময়কার ঢাকায় গাড়ি ঘোড়া তেমন নেই। সন্ধ্যার আগে রাস্তা আরো ফাঁকা ফাঁকা। একটা রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। চাচার আঙ্গুল ধরে যাচ্ছি। হটাৎ থেমে যেয়ে আঙ্গুল ধরে তাকে টেনে ধরলাম।
– কিরে দাঁড়িয়ে পড়েছিস কেনো ?
– :চাচা সাইকেল !
দূর থেকে একটা সাইকেল আসতে দেখে থমকে গেছি কারণ বাসা থেকে বলে দেয়া হয়েছে গাড়ি ঘোড়া দেখে রাস্তা পার হতে।
– দূর ব্যাটা।
আমাকে টেনে রাস্তার ওপারে নিয়ে গেলেন তিনি।
অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। একটু পরেই রাত হয়ে গেলো। চাচা লাল সুড়কি বিছানো পথ দিয়ে নিয়ে এলেন মসজিদের মতো গম্বুজওয়ালা রাজবাড়ীর মতো দেখতে এক বহুতল দালানের সামনে। সামনে বিশাল মাঠ। স্থানে স্থানে ফুলের কেয়ারী(এখন বুঝতে পারি তা ছিলো সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ) সেখানে বেশ কিছু তরুণ জড় হয়েছে। জটলা করছে। খালিমুখে বক্তৃতা দিচ্ছে একজন। মাঠে কোন বাতি নেই। আলো -আঁধারিতে দেখা গেলেও কাউকে চেনা যাচ্ছে না। হটাৎ সে বহুতল দালানের একটি অন্ধকার কক্ষের জানালায় মাইক লাগিয়ে ঘোষনা করা হলো –
– জরুরি এলান। জরুরি এলান। রাত আটটার পর থেকে কারফিউ। আটটার পর কাউকে বাইরে পাওয়া গেলে গুলি করা হবে। তাহলে এটাই সেই দুষ্ট দৈত্য। ভাবলাম বিরাট এক কাজ করে ফেলেছি। দৈত্যটাকে দেখে ফেলেছি। চাচা আমাকে হাত ধরে টেনে দ্রুত বাড়ির পথ ধরলেন। বাসায় তখন সিলেটি ভাষার চর্চা হতো। ঘরে ঢুকেই উত্তেজিতভাবে বাবা মাকে বললাম সিলেটি ভাষায় –
– আইজ আমি গর্মেন্টরে দেখছি। আন্ধাইর ঘরো লুকাইয়া থাইক্যা গুলি করে।
গভর্নমেন্ট শব্দটা উচ্চারণ করতে পারতাম না তখন । আব্বা-আম্মা হেসে গড়িয়ে পড়লেন।
* লেখক মেডিকেলের অধ্যাপক ,বাংলা একাডেমির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক পুরস্কার প্রাপ্ত, চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাংলা প্রচলনের অগ্রদূত ও বাংলায় প্রথম মৌলিক সার্জারি গ্রন্থ প্রণেতা।