পাথরে খোদাইকরা অনেকগুলো মূর্তি। পুরনো গীর্জাটার পাঁচিল ঘেঁষে নির্দিষ্ট দূরত্বে সাজানো। কোনোটা দেবতার, কোনোটা রাজার আবার কোনোটা বিশপের। প্রায় সবগুলো মূর্তির অভিব্যক্তিই প্রশান্ত, প্রাণবন্ত। শুধু একটার, ভবনটার উত্তর দিকের ঢালে, শীতলতম অংশে বাসানো, মাথায় মুকুট নেই, বিশপের টুপি নেই, নেই সন্নাসীর জ্যোতিচক্র। রুক্ষ, কঠিন চেহারা। মস্তক অবনত।
এটা নিশ্চই কোনো অপদেবতার মূর্তি, বলাবলি করে মোটাসোটা নীল পায়রাগুলো। দিনভর এরা দাঁড়ে বসে থাকে, পাঁচিলের কার্নিসে বসে রোদ পোয়ায়। তবে গীর্জার ঘন্টাঘরের বুড়ো দাঁড়কাকটা, এ যাজকীয় স্থাপত্যগুলোয় যার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব, জানাল- এটা এক হারিয়ে যাওয়া আত্মার প্রতিকৃতি। এখানেই মিটে গিয়েছিল বিষয়টা।
কিন্তু এক শরতশুভ্র দিনে গীর্জাটার ছাদের উপর দিয়ে ফুরফুর করে উড়ে এল একটা ছোট্ট গায়ক পাখি। অনেক দূর থেকে আসছে ও। ফসলহীন মাঠ আর ক্ষয়িষ্ণু ভূর্জবেষ্টনীর ওপার থেকে, আসন্ন শীত কাটানোর আশ্রয়ের খোঁজে। গীর্জা প্রাঙ্গণের এক দেবতার মূর্তির ডানার ছায়ায় বসার চেষ্টা করল ও, আরাম করে বসতে চাইল খোদাই করা একটা রাজকীয় গাউনের ফোকরে। কিন্তু পায়রাগুলো ও যেখানে বসে সেখান থেকেই তাড়িয়ে দেয়। আর হুল্লোড়ে চড়–ইঘুলো পাঁচিলের কার্নিস থেকেও ওকে ভাগিয়ে দিল। কোনো খান্দানি পাখি দরদ দিয়ে গান গায় না, টিঁ টিঁ করে মতবিনিময় করে। তাই আগন্তুক পাখিটাকে ছোটার মধ্যেই থাকতে হল।
শেষ পর্যন্ত আবডালের হারানো আত্মার মূর্তিটা ওকে আশ্রয় দিল। কবুতরগুলো এখানে বাসা বাঁধা নিরাপদ মনে করে না- হেলে পড়েছে মূর্তিটা। তা ছাড়া এখানে ছায়া অনেক গাঢ়। অন্যান্য স্বর্গীয় মান্যবরদের মতো ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে আড়াআড়ি হাত রাখে নি ও। ওর হাতগুলো আত্মরক্ষার ভঙ্গীতে ভাঁজ করা। ভাঁজ করা হাতের কোন ছোট্ট পাখিটার জন্যে চমৎকার একটা বিশ্রমাগার তৈরি করেছে। ঝড়-বৃষ্টি-শীত থেকে আগলে রাখবে ওকে।
রোজ বিকেলে নির্ভয়ে মূর্তিটার পাথুরে বুকের কোনে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে গায়ক পাখি। ওর মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় আশ্রয়দাতার সুখনিদ্রা পাহারা দিচ্ছে। নিঃসঙ্গ গায়ক পাখিটা ইতোমধ্যে ওর সঙ্গীহীন আশ্রয়দাতাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে দিনের বেলা, বৃষ্টির পানিতে ভেসে আসা জঞ্জাল নয়তো খিলানের পিল্লায় বসে মিষ্টি সুরে আশ্রয়দাতার প্রশস্তি গায়।
বাতাস কিংবা আবহাওয়ার প্রভাবেই হোক অথবা অন্য কোনো কারণেই হোক পাখিটার আশ্রয়দাতার বুনো, রুক্ষ চেহারার কাঠিন্য আর অতৃপ্তি একটু একটু করে কমছে। প্রত্যেক দিন, একঘেয়ে দীর্ঘ ঘন্টাগুলো জুড়ে, নিঃসঙ্গ প্রহরীর অতৃপ্ত আত্মায় তৃপ্তি এনে দেয় খুদে অতিথির গান। আর যখন সান্ধ্য প্রার্থনার ঘন্টা বেজে ওঠে, গোপন আস্তানা থেকে পিছলে বেরিয়ে আসে বিশাল ধূসর বাদুড়গুলো, ফিরে আসে উজ্জ্বল চোঁখের গায়ক পাখি। আশ্রয় নেয় প্রতীক্ষারত নিঃসঙ্গ প্রতিকৃতির বাহুডোরে। গায় ঘুম পাড়ানি গান। ধোঁয়াটে প্রতিকৃতিটার জন্যে সুখের ছিল সেই দিনগুলো। তবে গীর্জার বিশাল ঘন্টাটা ঢং ঢং করে বিদ্রুপ করত, ‘সুখের পর… দুঃখ আসে।’
বিশপের কেবিনের বাসিন্দারা লক্ষ্য করেছে বাদামী রঙ্গের একটা ছোট্ট পাখি গীর্জার আঙ্গিণায় ফুরফুর করে উড়ে বেড়ায়। মিষ্টি সুরে গান গায়। ওরা পাখিটার গানের তারিফ করে। ‘দুঃখের বিষয় হলো’ বলল ওরা, ‘কম্পিত কন্ঠের এ মিষ্টি সুর হারিয়ে যাবে গীর্জার সীমানার বাইরে। এই সুর লহরীর অকারণ অপচয় হবে।’ এরা গরীব হলেও রাষ্ট্রীয় পোষণবিদ্যার মূলসত্ত্বা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। তাই এরা পাখিটারেক ধরে আনল এবং একটা বাঁশের খাঁচায় পুরে কেবিনের দরজার কাছে রেখে দিল।
সেই রাতে ছোট্ট গায়ক পাখি ডেরায় ফিরল না। অন্ধকারের প্রতিকৃতিটা অকাকীত্বের যন্ত্রনায় ছটফট করল। ভাবল, হয়তো ওর ক্ষুদে বন্ধু ওত পেতে থাকা বিড়ালের থাবায় অথবা ছুঁড়ে দেয়া পাথরের আঘাতে নিহত হয়েছে। হয়তো… ভাবছে সে… উড়ে গেছে আর কোনোখানে। কিন্তু সকালের দিকে গীর্জার কর্মচাঞ্চল্য আর হইচই এর ভিতর থেকে ভেসে এল বাঁশের খাঁচায় বন্দীর করুন রোদন।
রোজ দুপুরে নাদুসনুদুস পায়রাগুলো যখন খাবার খেয়ে শোরগোল করতে করতে নীরব হয়ে যায়, চড়ুইগুলো রাস্তার পাশের গর্তের পানিতে গোসলে ব্যস্ত থাকে- ভেসে আসে ক্ষুধা, আকুলতা আর অসহায়ত্বের করুন সুর। এমন এক আহ্বান যাতে সাড়া দেয়া যায় না। খাবারের সময় পায়রাগুলো বলাবলি করে হারিয়ের যাওয়া আত্মার মূর্তিটা আরও হেলে পড়েছে।
তারপর একদিন, বাঁশের খাঁচা থেকে কোনো সাড়া এল না। শীতকালের শীতলতম দিন ছিল সেটা। পায়রা আর চড়ুইগুলো গীর্জাটার ছাদ থেকে আশপাশে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখছে- উচ্ছিষ্ট খুঁজছে। এ ধরনের জঘন্য আবহাওয়ায় উচ্ছিষ্টের উপর নির্ভর করতে হয় এদের।
‘কেবিনের বাসিন্দারা আঁস্তাকুড়ে কিছু ফেলেছে কি?’ উত্তর দিকে নজর রাখা পায়রাটাকে জিজ্ঞেস করল অন্য একটা পায়রা।
‘শুধু একটা ছোট্ট মরা পাখি,’ বলল পর্যবেক্ষণকারী পায়রা।
সেই রাতে গীর্জার ছাদ থেকে পট্পট্ আর চুনসুরকির কাঠামো ভেড়ে পড়ার শব্দ হল। ঘন্টাঘরের দাঁড়-কাকটা বলল- মূর্তির গায়ে বরফের আঁচড় লাগার শব্দ এটা। আর যেহেতু অনেকগুলো তুষারপাত দেখার অভিজ্ঞতা আছে দাঁড়-কাকটার সবাই ধরে নিল- তা-ই হবে।
পরদিন সকালে দেখা গেল হারানো আত্মার প্রতিকৃতির উপরের অংশ ভেড়ে বিশপের ঘরের পাশে বালির স্তুপে পড়ে আছে।
চোখ পিট্পিট্ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চকিত পায়রাগুলো বলল, ‘ভালোই হয়েছে, এখন—খানে একটা দেবতার মূর্তি পাব আমরা। ওখানে অবশ্যই কোনো দেবতার মূর্তি বসাবে ওরা।’
‘সুখের পর… দুঃখ আসে’ ঘোষণা করল গীর্জার ঘন্টা।
* লেখকের অনুবাদ গল্পগ্রন্থ “ছায়াপথের চিড়িয়াখানায়” থেকে সংকলিত।